বিশেষ প্রতিবেদক
কলকাতার লালবাতি এলাকার রাম বাগানে ১৮৭৯ সালে এক বাঙালি হিন্দু পরিবারে জন্ম সুশীলা সুন্দরীর। তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস -এর সুশীলা সুন্দরী হিসেবে। এটা তার আসল নাম ছিল কিনা সেটা নিয়েও সংশয় আছে। ছোটোবেলা থেকেই সুশীলার নানা রকম ব্যায়ামের দিকে প্রবল আগ্রহ ছিল। কলকাতার সিমলা অঞ্চলে প্রফেসর প্রিয়নাথ বোস ব্যায়ামের আখড়া খুললে সুশীলা ও তার বোন কুমুদিনী সেখানে যোগ দেন এবং সার্কাসে যুক্ত হয়ে পড়েন। এবং খুব দ্রুতই অন্যান্য খেলার সঙ্গে বাঘের খেলা দেখাতে শুরু করেন।
এর আগে সার্কাসে বাঘের খেলা দেখানো হলেও সেই বাঘগুলোকে চেন দিয়ে বেঁধে তবে খেলা দেখানো হত। গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধায় ‘গোপাল’ নামের বাঘের সঙ্গে কুস্তি লড়তেন। কিন্তু এই খেলায় বাঘের গলায় চেন পরানো থাকত। এবং সেই চেনের শেষ প্রান্ত থাকত অন্য এক লোকের হাতে। বিপদের বিন্দুমাত্র আশঙ্কা থাকলে সেই চেন টেনে বাঘকে সরিয়ে দেওয়া হত।
সে অর্থে বোসেদের সার্কাসে বাঘ খোলা রাখা হত। গ্র্যান্ড সার্কাসে বাদল চাঁদের পর যিনি এই খেলা দেখাতেন তিনি আর কেউ নন , এই বাঙালি মেয়ে সুশীলা। তার খেলা দেখাবার সময় বাঘেরা থাকত মুক্ত। খাঁচার ভেতর ঢুকে সুশীলা বাঘকে আদর করতেন , চুমু খেতেন। তাদের নিজের কথামতো দাঁড় করাতেন, বসাতেন , গর্জন করাতেন। এমনকি তিনি তাদের সঙ্গে বাহুযুদ্ধও করতেন , তাদের বিস্তৃত চোয়াল জনসমক্ষে দেখাতেন। এর পর এসব খেলা দেখানোর পর তিনি তাদের উপর হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন ছবি তোলার উদ্দেশ্যে। টানা আধ ঘণ্টার খেলার শেষে ছবি তোলা হলে উচ্ছ্বসিত দর্শকদের করতালির মধ্যে তিনি এসে দাঁড়াতেন স্টেজে।
বাঘের সঙ্গে খেলার জন্য সর্বাধিক আলোচিত হলেও তিনি আর একটি খেলা দেখতেন , সেটিও ছিল অতি বিখ্যাত -জীবন্ত সমাধি। সার্কাসের রিংয়ের এক কোণে সুশীলাকে গর্ত করে পুঁতে দেওয়ার পর সেই কবরের উপর বেশ কিছু দর্শক ঝাঁপাঝাঁপি লাফালাফি করে দেখতেন, ঠিকমতো কবর দেওয়া হয়েছে কিনা। তার পর সেখানে ঘোড়ার খেলা দেখানো হত। সেই শো শেষ হলে সুশীলা গর্তের মধ্যে থেকে হাসতে হাসতে স্টেজের উপর উঠে আসতেন।
জানা যায় একবার সার্কাসে শো চলাকালে সুশীলাকে কবর দেবার পর হঠাৎ ঝড় ও মুষলধারে বৃষ্টি নামে। সার্কাসের শো বন্ধ করে দিতে হয়। বাড়ি ফিরে প্রফেসর বোসের মনে পড়ে সুশীলাকে কবর থেকে তোলা হয়নি। তিনি দ্রুত ফিরে যান মাঠে। দেখেন সেই কবর থেকে সুশীলা গায়ের জোরে উঠে এসেছেন মাটি ফুঁড়ে।
পুরনো কলকাতার ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায়, গ্রেট বেঙ্গলের খ্যাতনামা জাদুকর, প্রিয়নাথের ডানহাত ম্যাজিশিয়ান গণপতির সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয়েছিল সুশীলার। ইনি সার্কাসে যোগ দেন বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকার জন্যে, কিন্তু অল্প সময়ে তার প্রতিভা প্রিয়নাথ বসুর নজরে আসেন। পরে গণপতি অন্য দলে যোগ দিলেও সুশীলা পুরনো দল ছেড়ে গণপতির নতুন দলে যোগ দেননি। কথিত আছে যে, সুশীলাকে ছাড়া নাকি নতুন দলে ভোজবাজি জমাতে পারতেন না গণপতি।
যা হোক, এ শক্তিময়ী সুশীলা সুন্দরীর ভক্ত সংখ্যা ও জনপ্রিয়তা যে তুঙ্গে ছিল তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। সুশীলা সুন্দরীর খ্যাতি সেই সময়ে এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে সব সময় ভারতীয়দের নিন্দা করা ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার সম্পাদকও লিখতে বাধ্য হন ‘হিন্দু স্ত্রীলোকদিগের দুর্নাম যে তাহারা বড় ভীরু, কিন্ত্ত এই সুশীলা সুন্দরী একগাছি ছড়ি পর্যন্ত না লইয়া, নির্ভয়ে ব্যাঘ্র -বিবরে প্রবেশপূর্বক দুইটি বাঘের সহিত খেলায় এরূপ অমিত সাহসের পরিচয় দেন, যে তাহা দেখিলে সত্যই চমকিত হইতে হয়।’
খ্যাতির মধ্য গগনেই সুশীলাকে সার্কাস থেকে সরে যেতে হয় এক দুর্ঘটনার জেরে। সুশীলা যে বাঘদু’টিকে নিয়ে খেলা দেখাতেন তাদের একটি মারা গেলে নতুন এক বাঘ ‘ফরচুন ’কে নিয়ে খেলা দেখাতে যান তিনি। এই বাঘটি তখনও পুরোপুরি ট্রেনিং পেয়ে উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। শোনা যায় , এই বাঘটির উপযুক্ত খাবার না পাওয়ার কারণে সেদিন তাকে আধপেটা করে রাখা হয়েছিল। সব খেলা শেষ করে সুশীলা যখন বাঘের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়েছিলেন তখন হঠাত্ বাঘটি থাবা দিয়ে জোরে আঘাত করলে ভীষণভাবে আহত হন তিনি। অতি কষ্টে সুশীলার প্রাণ রক্ষা হলেও ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়ে আর রিংয়ে ফেরা সম্ভব হয়নি তার।
১৯২৪ সালের মে মাসে সুশীলার মৃত্যু হয়। আর তার সঙ্গেই অবসান ঘটে ভারতীয় সার্কাসের সর্বাপেক্ষা সাহসী, জনপ্রিয় , অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কিংবদন্তি এক নায়িকার। আজ সার্কাসের মেয়েদের নানান খেলা দেখাবার সুযোগ থাকলেও ১২০-৩০ বছর আগে সুশীলা সুন্দরী যে সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, যুগের প্রেক্ষিতে তার তুলনা একমাত্র তিনিই।