সাইয়্যেদা লিজা
মরমী সাধক ও স্বভাব কবি বিজয় সরকার বাংলা মরমী সংগীত জগতের অন্যতম পুরোধা। গীতিকার, সুরকার হিসেবে তিনি এদেশের লোকসংগীতের কিংবদন্তী। পুরো নাম বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী। কিন্তু তিনি বিজয় সরকার নামে অধিক পরিচিত ছিলেন।
বিখ্যাত এই কবিয়াল ও বিচ্ছেদী গানের কিংবদন্তী বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী ১৯০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নড়াইল জেলা সদরের ডুমদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিজয়ের পূর্বপুরুষ হলেন বৈষ্ণব গুরু নাটু বৈরাগী ও উদ্ধব বৈরাগী। তাঁর বাবা নবকৃষ্ণ বৈরাগী ও মা হিমালয় কুমারী বৈরাগী । সনাতন ধর্মাবলম্বী নবকৃষ্ণ ছিলেন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের। নবকৃষ্ণের নয় সন্তানের মধ্যে পাগল বিজয় ছিলেন সবার ছোট।
পড়াশোনা ও সংগীত
শিশু বিজয় যেন দুর্দান্ত প্রতিভা নিয়েই পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাই একাডেমিক পড়াশোনায় মন লাগেনি তাঁর। বিজয় স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে টেনেটুনে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর পাঠ চুকিয়ে কিছুদিন স্থানীয় টাবরা এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে তিনি স্থানীয় কাচারিতে নায়েবের চাকরি দেন। চাকরির অবসরে তিনি নানা ধরনের লোকসংগীতের চর্চা করেন। পাশাপাশি অভিনয়ে মন দেন। তিনি যাত্রাদলে অভিনয়ও করতেন।
কবি গানে যেভাবে আকৃষ্ট
১৯২৫ সালের কথা। বিজয় গোপালগঞ্জ যান। সেখানে তিনি বিখ্যাত কবিয়াল শিল্পী মনোহর সরকারের কবিগান শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি মনোহর সরকারের শিষ্যত্ব নেন। এরপর বিজয় দুর্গাপুরে গুরুগৃহে থেকে সংগীতে তালিম নেন। গুরু মনোহর সরকারের কাছে দুবছর এবং এরপর আরেক বিখ্যাত কবিয়াল রাজেন্দ্র নাথ সরকারের কাছে এক বছর কবিগানের তালিম নেন। পরে ১৯২৯ সালে নিজেই গঠন করে কবিদল। এভাবে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ হয়। সেই থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত কবিয়ালদের প্রতিষ্ঠা চরমে উঠেছিল এই উপমহাদেশে। যদিও তার আগে ও পরে ভারত উপমহাদেশে শতাব্দী জুড়ে কবিগানের বিস্তৃতি ঘটেছিল।
কবিয়াল গান
কবিগানের উৎপত্তি সম্পর্কে বিশ্লেষক সজনী কান্ত দাস বলেন-‘এদেশে বাংলা ভাষাভাষিদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তরজা, পাঁচালী, খেইড়, আখড়াই, হাফ, দাঁড়ানো-কবিগান, বসা-কবিগান, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা এ ধরনের নানা বিচিত্র বিষয়াবলীর সংমিশ্রণে কবিগান জন্ম ও প্রসিদ্ধি পেয়েছিল। কবি বলতে এখানে অশিক্ষিতদের মনে করা হতো। কিন্তু তাঁরা বেদ-পুরাণ, রাজনীতি-ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল স্বভাবকবি। এই কবিদের কবিয়ালও বলা হয়ে থাকে। এই কবিগানের আসর মূলত দুইদল প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পীর বিতণ্ডা। কবির সুর ও তাল সহযোগে তৎক্ষণিক পদ্য আকারে করে একের প্রশ্নের জবাব দেওয়া। অর্থাৎ প্রথমে একদল কোনও এক বিষয়ে গান গাইবে। পরে প্রতিদ্বন্দ্বী দল গানের মধ্যদিয়ে সেই উত্তর দেবে। সেখানে থাকবে যুক্তি, ছন্দ নাটকীয়তা। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং নানা অনুষঙ্গের ব্যবহার, রাগবিস্তার, কঠিন যুক্তিজাল করে অপর পক্ষকে আক্রমণ এবং নিজেদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে কবিয়ালাদের হার-জিত ।
বিতর্কের উত্তেজনা অনুসারে গানে বাদ্যযন্ত্র যেমন ঢোল, কাসি, মন্দিরা, করতালের আওয়াজ ও লয়ের তারতম্য হয়। তখনকার দিনে কবিগান ছিল অশ্লীলতাপূর্ণ , গেঁয়ো মূর্খদের গান। যা গান নারী-পুরুষেরা একত্রে বসে শোনার মত উপযোগী ছিল না। শোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্ট কবিগান সেই যুগের কবিদের কবিগান ছিল ‘সাময়িক কীর্তন’। কারণ এসব কবিয়ালেরা লিখিতভাবে কোনও পদ রেখে যাননি। কারণ সভাস্থলে কবিদের ‘‘সূচনা (Introduction) ও জবাব তির করতে হত। । কবিয়ালেরা শ্রোতাদের সামনে আসরে দাঁড়িয়ে গান রচনা করতে গিয়ে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে এতোটাই দিশেহারা হয়ে পড়তেন যে, বাক্য প্রয়োগের উদ্দেশ্য অনেকাংশে তাঁরা ভুলে যেতেন।
কিন্তু কবিগানের সেই আদিরূপকে শ্রোতাদের কাছে মনোমুগ্ধকর ও সর্বজনগ্রাহ্য করতে মনোনিবেশ করে এক নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন।
বিজয় সরকার এজন্য নরসিংদীর হরিচরণ আচার্য ও রাজেস সরকারের অনুসারী হন। তাঁদের সংস্পর্শে এসে বিজয় সরকার কবিগানে সংষ্কার আনতে মনোনিবেশ করেন। প্রাচীনকালের কবিয়ালেরা যেভাবে দেহ লোলুপ ছিলেন। অনেকাংশে তাঁরা নায়িকা রাঁধিকার প্রতি সন্দেহপোষণ করে অপ্রকৃত প্রেম সংগীত রচনা করেছেন। কিন্তু আধুনিক কবিয়াল সমাজের অগ্রদূত বিজয় সরকার সেখানে দেহাতীত প্রেমের এক অপূর্ব সুষমামণ্ডিত পদের ধারা প্রবর্তন করেন। বিজয়ের বিখ্যাত ‘সখীসংবাদ’ সংগীতে এর দৃস্টান্ত দেখা যায়-
‘‘কৃষ্ণ মিলন লাগি নিশি জাগি বাসর ঘরে
মিলন নিশি হইলো ভোর
এলো না শ্যাম কিশোর ’’
বিজয় সরকার বিখ্যাত কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও তিনি ছিলেন সংসার বিবাগী, উদাসীন এক মানুষ। ছিলেন আখড়া নিবাসী। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার ভক্তবাদী নর-নারীর আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে বিজয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। জীবনের শেষভাগে ভক্তদের ধর্মীয় উপদেশ ও দীক্ষা দিয়ে সময় কাটাতেন তিনি। তবে দীক্ষার বিনিময়ে তিনি কোনও ভক্তি বা অর্থ নিতেন না।
তাঁর মহা তিরোধানের পর পশ্চিমবঙ্গের একজন লেখক বাসুদেব গোলকার তাঁকে নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন। ‘শ্রী শ্রী পাগল বিজয়ামৃত’ নামে এই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন,জনৈক এক বাঙালী মুসলিম সম্প্রদায়ের (বাংলাদেশের অধিবাসী) ব্যক্তির চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিজয় সরকার তাঁর নিজের দুটি চোখই তাকে দান করে দৃষ্টিদান করেন। এরপর বিজয় চিরকালের জন্যে অন্ধত্ববরণ করেন।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলাদেশে কবিগানের উৎকর্ষ সাধন ও কবিগানের ধারাকে আধুনিকীকর এবং জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিজয় সরকারের অবদান অপরিসীম। কবিগানে ভাটিয়ালি সুরে রচিত তাঁর ধুয়াগান বিঝয় সরকারকে বিপুল জনপ্রিয় করে তোলে। বিজয় সরকার জীবনভর শুধু দুটি ধারার গানই পরিবেশন করে গেছেন। এক. কবিগান, দুই. রামায়ণ গান। তবে জারিয়ালদের সঙ্গে তিনি কবি ও জারি গানের পালা করেছেন। বাংলা সংগীতাঙ্গনে বিজয় সরকার কবিগানকে বিশেষরূপে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর রচিত কবিগান যেমন ছিল নিরপেক্ষ ও নবতর। এজন্য তা শ্রোতাদের প্রাণে এক নতুন চেতনার বিকাশ ঘটায়। তাঁর নিরপেক্ষ স্বরবৃত্ত ছন্দের অপূর্ব কবিগান সংগীতাঙ্গনে বলা চলে একন নব জাগরণ সৃষ্টি করেছিল।
তাঁর একটি ভবানীবিষয়ক গান এমন-
‘‘ওমা ব্রক্ষ্মময়ী তোর ব্রক্ষ্মান্ডে ধর্ম ফলে কর্মকান্ডে
প্রতি ভান্ডে অতি বিষ্ময়ের
মানুষ স্বকর্মে করে কসুর, স্বভাবের মাঝে অসুর
কর্মে মধুর সাজে নারী-নর ’’
সংগীতের বিরল প্রতিভা বিজয় সরকার ভাটিয়ালী গানের সুরের সঙ্গে বাউলসংগীতের এক অপূর্ব সংমিশ্রন ঘটিয়ে এক নতুন ধারার সংগীতের সূচনা করেন যা আমাদের লোকসংগীতের বিশাল বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি। এজন্য বিজয়ের এক আলাদা ঘরানা সৃষ্টি হয়। এসব গানকে বিচ্ছেদ- ভাটিয়ালী গান বলে ধরা হয়।
তাঁর এসব গান শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের কাছে এক অপূর্ব হৃদয়গ্রাহী সংগীত হিসেবে বিবেচিত হয়। বিজয় সরকারের রচিত গানের সংখ্যা প্রায় পৌনে ৪০০। রাধাবিচ্ছেদ, কৃষ্ণবিচ্ছেদ, বারাষিয়া, সারি, ধুয়া, অষ্টকগান, পদকীর্তন, ইসলামী গান, ডাকগান, সখি সংবাদ, গোষ্ঠগান, কবিগান প্রভৃতি এসব তাঁর অনবদ্য রচনা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, বিখ্যাত ভাটিয়ালি শিল্পী আববাস উদ্দীন আহমদের মত কবি-সাহিত্যিক ও প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর ছিল মধুর ঘনিষ্ঠতা ।
প্রায় ৫৫ বছর সঙ্গীত সাধনা করেছেন বিজয় সরকার। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমিতে সংগীত পরিবেশন করেছেন তিনি। পেয়েছেন অনেক পুরষ্কার ও সম্মাননা। ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর এই সাধক পুরুষের মৃত্যুবরণ করেন।