• Home  / 
  • ইতিহাস  / 

পৃথিবীর কয়েকটি আদিম জনগোষ্ঠি, যাদের কাছে পৌঁছেনি সভ্যতার আলো

নভেম্বর ২৩, ২০১৮
Spread the love

ইসলাম রাকিব

পৃথিবী আধুনিকতার চরম মুহূর্ত অতিক্রম করছে। কিন্তু এই সময়েও পৃথিবীতে বেশকিছু আদিম জনগোষ্ঠি আছে যারা এখনো এই সভ্যতায় গা না ভাসিয়ে তাদের ঐতিহ্য ধরে আছে।  যদিও সংখ্যাগত দিক থেকে তারা ক্রমে বিলুপ্ত হচ্ছে। কিন্তু এখনো টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করছে আদিম এই জনগোষ্ঠির সদস্যরা।

এমন  যেসব  আদিম জনগোষ্ঠী বিলুপ্ত হতে চলেছে তাদের মধ্যে ব্রাজিলের ‘আওয়া’ (Awa) বা ‘গুয়াজা’ (Guajá) একটি। আদিম এই জনগোষ্ঠির বাস ব্রাজিলের পূর্ব আমাজনে। এই জনগোষ্ঠীর বর্তমান জনসংখ্যা  ৩৫০ জন।  এরমধ্যে ১০০ জন আছেন যারা বাইরের দুনিয়ার কোনো খবরই রাখেন না বা জানেনা।

জানা যায়, উনবিংশ শতাব্দীতে এই জনগোষ্ঠির সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার ৮০০ জন। তবে ইউরোপিয়দের আগমনের কারণে তাদের অনেকেই বাস্তুচ্যুৎ হন। নগ্ন ও আদিম এই জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তি ঠেকাতে বিশ্বব্যাংক ১৯৮২ সালে উদ্যোগ নেয়। ওই বছর বিশ্বব্যাংক ব্রাজিল সরকারকে ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেয় দেশটির সরকারকে।

পিগমি
 মধ্য আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নাম পিগমি। এরা  প্রধানত হ্রস্বকায় বলে বিশেষভাবে পরিচিত। এরা আফ্রিকার আদিমতম জনগোষ্ঠী। এক সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও এই আদিম জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব ছিল। এরা মূলত ফিলিপিনসের ‘ইয়েতা’ আদিবাসী।  আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেও আদিম এই  পিগমিদের অস্তিত্ব রয়েছে। তারা আছে পাপুয়া নিউগিনির দুর্গম এলাকায়।

পিগমি বলতে সাধারণত হ্রস্বকায় যে কোনো প্রাণী বোঝানো হলেও পিগমিরা মূলত বামনাকৃতির বনবাসী এক আদিম মানবসম্প্রদায়।

ইতিহাসবিদদের মতে, খ্রীস্টপূর্ব ২২৫০ অব্দের এক চিঠিতে পিগমিদের কথা অস্বিস্তের কথা  উল্লেখ  আছে।তবে সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাযবাহিকতায় এই জাতিগোষ্ঠী এখন বিলুপ্তির পথে। জানা যাচ্ছে, বর্তমানে পৃথিবীতে পিগমি জনগোষ্ঠির সংখ্যা ১ লাখের বেশি নয়।  দৈহিক গঠন অনুযায়ী এই জনগোষ্ঠির মানুষদের উচ্চতা সব্বোর্চ্চ সাড়ে ৪ ফুট।তাই প্রাপ্তবয়স্ক আর শিশুর মধ্যে উচ্চতার তফাৎ করা  কঠিন।

বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানতে পারেন,  এই আদিম মানুষদের খর্বাকৃতির কারণ হচ্ছে, শরীরের উচ্চতা বাড়ানোর জন্য যে ইনসুলিন জাতীয় আইজিএফ নামের উপাদানটি কাজ করে, পিগমিদের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। এ কারণেই এরা হ্রস্বকায়। জঙ্গলে পিগমিরা নিজেরাই ঘরদোর তৈরি করে বসবাস করে। খর্বাকৃতির হওয়ার কারনে তাদের ঘরগুলোও আকারে-উচ্চতায় ছোট। জঙ্গলবা্সী এই আদিম মানুষেরা  শিকার করে জীবন ধারণ করে। দলবেঁধে পিগমিরা শিকারে যায়। তারা বন্যপশু শিকার করে আহার করে। তাদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার  ‘বল্লু ডুকার’ নামে এক ধরনের ছোট হরিণের মাংস। তারা বন্যপশু শিকার করে জালে আটকে। তারা এই জাল বোঁনে ‘এনকুসা’ নামে এক ধরনের দৃঢ় গুল্ম দিয়ে। ফলে জালগুলো  খুবই শক্ত-পোক্ত। বন্যপশু শিকারের সময় তারা জালগুলো কোমর সমান করে পেতে ছোট কাঠের ডাল দিয়ে নিচগুলো ভালো করে আটকে দেয়। এরপর  শিকারকে তাড়িয়ে জালে এনে আটকায়। শিকার যদি হাতি বা ওই ধরনের বড় আকৃতির কিছু হয়, তবে জালবন্দী অবস্থায় তীর মেরে দুর্বল করে পশুকে ধরাশায়ী করে। শিকার নিয়ে তারা দলবেধে গ্রামে ফেরে। পশু শিকারের আনন্দে পিগমি নারীরা দলবেধে নৃত্য করে। তাদের বিশ্বাস, গর্ভাবস্থায় কোনো নারীর সামনে  শিকার পরবর্তী  এই উৎসব সৌভাগ্যের প্রতীক। পিগমি জাতিগোষ্ঠীর দলনেতা আছে। এই দলনেতা নির্বাচিত হযন কঠিনতর পরীক্ষার মধ্যমে। দলনেতা হতে হলে তাকে পাকা শিকারি হতে হয়।

জানা যায়,পিগমি জাতিগোষ্ঠীর কয়েকটি উপজাতি হলো Mbenga (Aka এবং Baka), Mbuti এবং Negrito। ক্যামেরুন, কঙ্গো ও গ্যাবনের জঙ্গলে Mbenga উপজাতির বসবাস। কঙ্গোতে Mbuti প্রজাতির প্রায় ৩০-৪০ হাজার পিগমি আছে।

কারেন পাদায়েং
কারেন পাদায়েং উপজাতির বসবাস বর্তমান মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের Mae Hong Sorn এবং Phrae প্রদেশে। কারেন পাদায়েং উপজাতির নারীদের গলা অস্বাভাবিক রকমের লম্বা। এটাই এই গোষ্টির  নারীদের সৌন্দর্যের প্রতীক।  মেয়েদের বয়স যখন  ৫-৬ বছর হয় তখন  পুরুষরা তাদের গলায় একটি তামার স্প্রিং পরিয়ে দেয় যাতে স্প্রিংয়ের টানে মেয়েদের গলা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লম্বা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে তরুণীদের গলা প্রায় ১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে যায়। তারা এই স্প্রিং সবসময় পরে থাকে তাদের বিশ্বাস স্প্রিং খুললেই তাদের ঘাড় যে কোনো সময় মটকে যাবে। বিয়ের আগে কানের দুল পরেনা এই উপজাতির মেয়েরা।

আদিবাসী জারোয়া

বঙ্গোপসাগরের দুর্গম আন্দামান দ্বীপে  এক সময় ব্রিটিশ ভারতের কারাগার ছিল। যা পরিচিত ছিল ‘কালাপানি’ নামে। ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও অন্যান্য অপরাধীদের পাঠানো হতো আন্দামানের এই  কুখ্যাত সেলুলার কারাগারে। আন্দামান ও নিকোবর নামে এই দুটি রাজ্য ভারতের  কেন্দ্রশাসিত। ভারতের ৫৭২টি ছোট- বড় দ্বীপ নিয়ে এই রাজ্য গঠিত। দুটি দ্বীপের বেশির ভাগ এলাকা জনবসতিহীন-দুর্গম। দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অংশে রয়েছে গভীর ঘণ জঙ্গল। এখানেই বাস  জারোয়া, ওঙ্গি, গ্রেট আন্দামানিজসহ বেশ কয়েকটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের। তারাই এই আন্দামান দ্বীপের আদিম মানুষ।

 ধারণা করা হয়ে থাকে, আফ্রিকা থেকে যে সব মানুষ প্রথম এশিয়ায় পাড়ি জমান, তাদের বেশিরভাগেই তাদের বংশধর। এখন এসব সম্প্রদায়ের মাত্র কয়েকশ করে  মানুষ টিকে আছে। জারোয়াদের বাস  আন্দামা দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে।  সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাত্রা এখনো আদিম । জারোয়ারা বস্ত্রহীন বা অর্ধ বসন থাকে।  জীবজন্তু ও ফলমূল আর সমুদ্রের মাছ তাদের মূল আহার। বাইরের মানুষ ঢুকে পড়লে তাদের বিষমাখা তীর ছুঁড়ে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না জারোয়ারা সম্প্রদায়ের লোকেরা। এ জন্য জারোয়া এলাকায় পর্যটক কিংবা বাইরের অন্য কোনো মানুষের  প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাইরের সমাজ ব্যবস্থার  প্রভাব  এবং সক্রামন থেকে আদিবাসীদের সুরক্ষা দিতে  এই নিষেধাজ্ঞার কারণ। জারোয়াদের এই আবাসস্থলকে এজন্য সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আন্দামানে এমন ৪০৪ জন জারোয়া সম্প্রদায়ের লোকের অস্বিস্ত আছে।  

জুলু
আফ্রিকা মহাদেশের একটি জনগোষ্ঠীর নাম জুলু।  এদের বসতি দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়া-জুলু নাটাল প্রদেশে। জুলুদের উৎপত্তি উত্তর কোয়া-জুলু নাটাল প্রদেশের অপর একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ‘উনগুনি’ সম্প্রদায় থেকে। জুলু জাতির জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়  জুলু কান্টোমভেলাকে। ইতিহাস বলছে, ১৭০৯ সালে জুলু  জাতির গোড়াপত্তন করেন জুলু কান্টোমভেলা। তখন এই প্রদেশটিতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উনগুনি জাতিগোষ্ঠীর বসতি ছিল।

উনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলুদের  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ওই সময় কৃষ্ণাঙ্গ জুলুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গন্য করা হত। কিন্তু বর্তমানে তারা সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর  স্বীকৃতি পেয়েছে। আধুনিক জুলু সম্প্রদায়ের লোকজন শহর এবং গ্রাম উভয় অঞ্চলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যদিও কোয়া-জুলু নাটালই এখনও তাদের মাতৃভূমি হিসেবে স্বীকৃত, তবু জুলুদের অনেকেই এখন পার্শ্ববর্তী গটেং প্রদেশে  বসতি গড়েছেন।  এখন এই প্রদেশেও  বেশি কথিত ভাষা  জুলু । দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে জুলুদের  উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এবং বর্তমান উভয় উপ রাষ্ট্রপতি জুলু জাতির। তারা হলেন যথাক্রমে জ্যাকব জুমা এবং ফুমজিল উমলাম্বো-উংগুকা।

জুলুদের  ভাষা জুলু বা ইসিজুলু। জুলু দক্ষিণ আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশি কথিত ভাষা।  প্রায় অর্ধেক মানুষই এই ভাষা বুঝতে পারে। মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়েতে রয়েছে জুলু সম্পদায়ের লোকদের বসবাস। তাদের ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টান (রোমান ক্যাথলিক অথবা প্রোটেস্ট্যান্ট)। তবে জিম্বাবুয়েতে বসবাসকারী অনেক জুলু কেউ প্রকৃতি পুজারি আবার কেউ আধা খ্রিস্টান।  তকে অন্য সব জুলু প্রকৃতি পুজা করে।

 এস্কিমো
‘এস্কিমো’ অপর এক নৃগোষ্ঠী যারা  উত্তর আমেরিকার আলাস্কা, কানাডা ,গ্রিনল্যান্ড ও পূর্ব সাইবেরিয়া সুমেরু অঞ্চলের বরফ আচ্ছাদিত অঞ্চলে বসবাস করে। এস্কিমো
 (Eskimo) শব্দের অর্থ কাঁচা মাংস আহারকারী। এরা কাঁচা মাংস খায় বলে রেড ইন্ডিয়ানরা তাদের এই নামে ডাকে।

নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের ধারণা এস্কিমোরা এশিয়ার মঙ্গোলিয় জাতির বংশোদ্ভূত। বহু যুগ আগে জীবিকার তাগিদে তারা এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এস্কিমোরা Inuit–Yupik (আলাস্কায় Inupiat–Yupik) নামে পরিচিত। এস্কিমোদের জীবন খুব কঠিন। প্রচণ্ড শীতে এরা বসবাসে অভ্যস্ত। তবে তাদের  চাহিদা খুব সীমিত।

সমুদ্রের সিল, তিমি  এসব মাছ শিকার করে তারা খাদ্য, ঘরবাড়ি, তেল ও জ্বালানির ব্যবস্থা করে থাকে। গ্রীষ্মকালে এরা বলগা হরিণ ও সিলমাছের চামড়ায় নির্মিত  তাঁবুর নিচে বসবাস করে। আবার যখন প্রচণ্ড শীতে বরফ জমাট হয়ে যায়  তখন তারা বরফ খুঁড়ে পাথর বা ঢাকনা দিয়ে তাদের  নিবাস তৈরি করে তাতে বসবাস করে। এই ঘরকে বলা হয় ‘ইগলো’ (Igloo) । স্থলপথে এস্কিমোরা
চলাচলের জন্য কুকুরে টানা গাড়ি (স্লেজ)ব্যবহার করে। আর জলপথে ব্যবহার করে চামড়ার তৈরি ছোট নৌকা। এই নৌকার চামড়া Umiak বা Kayak নামে পরিচিত। গোটাবিশ্বে এস্কিমোদের সংখ্যা প্রায় কোটির কাছাকাছি। মৃত ভালুক, তিমি মাছ ও সিন্ধুঘোটক তাদের থাদ্য।