উপমহাদেশের নিষ্ঠুর খুনী সম্প্রদায় ‘ঠগী’

Spread the love

আয়না২৪ ডেস্ক

সংস্কৃত ঠগ শব্দ থেকে  ঠগী শব্দটির উৎপত্তি।  এর অর্থ ধোঁকাবাজ, প্রতারক। বাংলা অভিধানে ঠগী বলতে বিশেষ শ্রেণির এক দস্যু দলকে বোঝায় যারা পথিকদের ধোকা দিয়ে পরে গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে তাদের হত্যা করত। ঠগীরা ছিল ভারতবর্ষের একটি বিশেষ খুনী সম্প্রদায়। এদের মতো নিষ্ঠুর আর নিঁপুণ খুনী  পৃথিবীতেই শুধু নয়, ইতিহাসেও খুব বিরল।

ঠগীরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা  ধোকা দিয়ে যত মানুষ হত্যা করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। কেবল ১৮৩০ সালেই  প্রায় ৩০  হাজার মানুষকে হত্যা করে এই গোষ্ঠি।

১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়া উদ্দীন বারানির লেখা  ‘ফিরোজ শাহের ইতিহাস’ গ্রন্থে ঠগীদের কথা প্রথম প্রকাশ  পায়। এই  শ্রেণির মানুষেরা উত্তর ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে বংশ পরম্পরায় তাদের এই  নিষ্কঠুর কর্মকাণ্ড চলে। এরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াত, পথে যাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতো। তারপর সময় সুযোগ বুঝে যাত্রীদের মেরে ফেলে সবকিছু লুটে নিত।   ১৭ আর ১৮ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পথিকদের জন্য মূর্তিমান  আতঙ্কের নাম ছিল ঠগী।

কিন্তু বাংলায় তাদের আগমন ঘটে ১২৯০ সালের দিকে। ফিরোজ শাহের লেখা ইতিহাস বলছে,  ১২৯০ এর সুলতানি শাসনামলে  প্রায় হাজার খানেক ঠগ ধরা পড়ে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সুলতান তাদের কোনো রকম দণ্ড না দিয়ে দিল্লীতে ফিরে না আসার শর্তে, অনেকটা আপ্যায়নের সঙ্গে নৌকায় করে ভাটির দেশ- তথা  বাংলায় পাঠিয়ে দেন। আর তারপর থেকেই বাংলার জলে-স্থলে, মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পড়ে এই ধোকাবাজ খুনি সম্প্রদায়।  বাংলায় ঠগীদের ইতিহাসের সূত্রপাত সম্ভবত এখান থেকেই।

কয়েকশ বছর ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যেত অগণিত পথিক। কোথায়, কীভাবে হারিয়ে যেত, জানত না কেউ। কোনো এক জাদুবলে যেন তারা মুছে যেত পৃথিবীর বুক থেকে। কত মানুষ হারিয়েছিল এভাবে? গিনেস বুকের হিসাবে এই সংখ্যা ২০ লাখ! নিরীহ পথিকদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে তাদের মালামাল লুট করত যারা- ভারতীয় কিংবদন্তীতে তাদেরকেই ঠগী  বলা হয়।   

ঠগীরা সবসময় চলত দল বেঁধে। তারা ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমন করত। এরা লোকজনকে গোপনে বাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য  সংগ্রহ করত। তারপর যাত্রীদের সঙ্গে মিশে যেত। যাত্রা বিরতিতে যাত্রীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করত। সহযাত্রীদের সৌহার্দ্য, নিরাপত্তা আর বিশ্বাসের উষ্ণ আমেজে, গরম খাবার খেয়ে পথ চলতি ক্লান্ত যাত্রীরা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে থাকেন। আর তখনই আসতো সর্দারের হুকুম। সর্দারের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই যাত্রীদের ওপর ঘটতো নির্মম হত্যাকাণ্ড। একজন যাত্রীকে খুন করত তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ধরে রাখত,অন্যজন ফাঁস পরাত, আরেকজন পা চেপে ফেলে দিত। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা নেই, ঠগীদের অন্য দলটি কাছেই ওত পেতে থাকত।

ঠগীরা নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করতো। যেমন- ‘বাসন মেজে আনার কথা’ বলার মধ্য দিয়ে সরদার তার এক সংকেতকে কবর তৈরি করার নির্দেশ দিত। ‘ঝিরনী’ শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের  মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেওয়া হতো। এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস জড়ানো হতো শিকারের গলায়। যেকোনো সংগঠিত অপরাধী সমাজের মতোই এরূপ নিজস্ব নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় ঠগীরা নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করত। গোষ্ঠীভুক্ত না হলে এই সংকেতের পাঠোদ্ধার ছিল অসম্ভব।

বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগীরা। দলের সদস্যদের খুবই নির্দিষ্ট সব দায়িত্ব ছিল। সর্বাগ্রে থাকতো ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করা, তার সঙ্গে ভাব জমানো ও শিকার সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব থাকতো তাদের ওপর। পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখতো যারা তাদেরকে বলা হতো ‘তিলহাই’, তারা দল থেকে খানিকটা পিছনে থাকত। নিরাপদ জায়গা দেখে তাঁবু গড়ার দায়িত্ব থাকত ‘নিসার’দের উপর।

কবর তৈরি করার দায়িত্ব যাদের তাদের বলা হতো ‘বিয়াল’। শিকারকে যে ধরে রাখবে তাকে বলা হতো ‘চামোচি’। শিকার যাতে বাধা দিতে না পারে তার জন্য হাত আটকে রাখার দায়িত্ব ‘চুমোসিয়া’র। ‘চুমিয়া’ শিকারের পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে। ‘ভোজারা’ মৃতদেহগুলো কবরে নিয়ে যাবে । ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হলো দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া। মৃতদেহ পাহারা দেওয়া ও বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলা হতো ‘ফুরকদেনা’। আর হত্যাকাণ্ডের জায়গাটা সাফ করে ফেলার দায়িত্ব ছিল ‘ফুরজানা’দের।

সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসত ঠগীদের অমৃতের ভোজ। সে ভোজ আর কিছু নয়, গুড়ের ভোজ। একলা পথিক পেলেই সাদরে তাকে দলের সঙ্গে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাত। তাদের মতে, যে একবার এই গুড় খাবে, সে ঠগী হয়ে যাবে। ঠগীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিল।

ঠগীদের খুনের অস্ত্রটা ছিল বেশ অবাক করার মতো। অতি সাধারণ, কিন্তু সাংঘাতিক কার্যকর। এক ফালি হলদে কাপড়ের টুকরো। দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিট। তাতে একটা রুপোর টাকা বা তামার ডবল পয়সা বাঁধা। নিপুণ ঘাতকের হাতে সেটাই হয়ে উঠে অব্যর্থ মরণ ফাঁস।

ঠগীদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকার প্রথম জানতে পারে ১৮১২ সালে । সে সময় গঙ্গার ধারে একটি গণকবরের সন্ধান মেলে।  তাতে ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যাচ্ছিল গণকবর। এসময় ব্রিটিশদের বদন্যতায় যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি  হয়। রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা পায়। ফলে ঠগীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু পুরোপুরি তাদের মূলোৎপাটন করা যাচ্ছিল না।  ব্রিটিশ সরকার ঠগীদের নিমূর্ল করার জন্য উইলিয়াম শ্লিমানকে দায়িত্ব দেয়।

বেঙ্গল আর্মির ওই কর্মকর্ত  উইলিয়াম হেনরি শ্লিমান ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি দেখলেন, কিছুতেই অন্যান্য দুস্কৃতিকারীদের থেকে ঠগীদের পৃথক করা যাচ্ছে না। ঠগীরা নিঁপুণ কৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল। শ্লিমান গুপ্তচর নিয়োগ করলেন, গঠন করলেন বিশেষ পুলিশ বাহিনী ও আলাদা বিচার আদালত। পাশাপাশি ঠগীদের অপরাধস্থল বিশ্লেষণ করে তৈরি করলেন মানচিত্র এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা  যাতে পরবর্তী হত্যার সময়কাল আঁচ করা যায়। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ সেসব স্থানে পাঠাতে থাকেন।

তারপর ১৮৩০ সালে শ্লিমানের গুপ্তচরদের দক্ষতায় ঠগীরা দলে দলে ধরা পড়তে থাকে। এদের কারো কারো মৃত্যুদণ্ড, কারো যাবজ্জীবন জেল, কারো বা দ্বীপান্তর দিয়ে এদের দমন করতে সক্ষম হন শ্লিমান। বাকী যারা ছিল তারা ভয়ে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। এভাবে ভারতবর্ষ ঠগী মুক্ত হয়।

ঠগীদের দীর্ঘ বিচারপর্বে উঠে আসে  বিচিত্র কাহিনী যা শুনে সভ্য সমাজের সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঠগীদের জবানবন্দি থেকে খুনের যে হিসাব পাওয়া যায় তা ছিল খুবই মর্মস্পর্শী। ১৯৩৩ সালে উইলিয়াম শ্লিমানের নাতি জেমস শ্লিমানের লেখায় জানা যায়, একজন ঠগী মাসে গড়ে  ৮-১০ জনকে খুন করত। সে হিসেবে প্রায় ২০ লাখেরও অধিক মানুষ এই ঠগীদের শিকার হয়েছিল বলে অনেক বিশেষজ্ঞদের ধারণা।  বাহরাম বলে এক নিষ্ঠুর ঠগীর নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৯৩১ জন মানুষকে সে খুন করেছিল বলে দাবি করে এবং পরবর্তীতে তার নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডে ওঠে। সে আরেক গল্প। কিন্তু ঠগীদের এই নিষ্ঠুরতম ইতিহাস আজকালের অতলে হারিয়ে গেলেও মাঝে মাঝে পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনা সেই ইতিহাসকে নতুন করে রোমন্থনের সুযোগ করে দেয়।