চেঙ্গিজ খানের সমাধিক্ষেত্র ঘিরে রত্নভান্ডার!

Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

 আমরা যাকে ইতিহাসের বদৌলতে চেঙ্গিজ খান নামে জানি আসলে এটা তাঁর নাম নয় উপাধী। তাঁর প্রকৃত নাম তিমুজিন। তিনি  তাঁর মঙ্গোলিয়রা তাঁর অসাধারণ শৌর্য, বীর্য ও পরাক্রমের জন্য তাকে ‘চেঙ্গিজ খান’ উপাধি দেয়। এর অর্থ ‘বিশ্বজনীন অধিপতি’।

চেঙ্গিজ খান খ্যাত পরাক্রমশালী বীর তিমুজিন প্রায় ২১ বছরে শাসক ছিলেন।  এই সময়ে তিনি জয় করেন পারস্য চীন, ভারত, ইউরোপ, ভারত ও এশিয়ার প্রায় এক  কোটি বর্গ কিলোমিটার আয়তন। আমৃত্যু  তিনি অপরাজিতই ছিলেন।

ঐতিহাসিকদের মতে, চেঙ্গিজ খান ১২২৭ সালে মারা যান। তবে কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে সে সম্পর্কে  সুস্পষ্ট  তথ্য আজও পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে  মারা যান।  কারো মতে, কোনো এক রাজকন্যার দ্বারা খোজা করণের ফলে  তার মৃত্যু হয়। তবে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হয়, পশ্চিম  সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালানোর সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর পর তাকে মঙ্গোলিয়া ফিরিয়ে আনা  এনে সেখানেই কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে  সমাধিস্থ করা হয়।  

চেঙ্গিজ খানের মৃত্যু তার বিজয়গাঁথার সমাপ্তি ঘটালেও তাকে নিয়ে রহস্য থেকেই গেছে। যুগের পর যুগ  মানুষ এই মঙ্গোলিয় এই বীর সম্রাটের সমাধিক্ষেত্র খুঁজে ফিরছে এই রহস্যের কিনারা করতে।  এখনো খুঁজে চলেছে ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু ইতিহাস কি আর এই রহস্যের সমাধান দিতে পারেনি। কথিত আছে এই মঙ্গোলিয় সম্রাট মৃত্যুর  নাকি  বলে গিয়েছিলেন, তাকে যেন গুপ্ত স্থানে সমাহিত করা হয়। সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে তাকে গুপ্ত স্থানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল । এবং যারা তাঁর গোরখোদক ছিল পরে তাদেরও হত্যা করা হয়েছিল এবং বাকিরা আত্মহত্যা করে। মনে করা হয়, চেঙ্গিজ খানের সঙ্গে অর্ধেক পৃথিবীর ধন-সম্পদ ও তার জয় করা ৭৮ জন রাজার মুকুটও তার মরদেহের সঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। আর কিছু সুন্দরী নারীকেও হত্যা করে তার সঙ্গে  সমাধিস্থ করা হয়েছিল যাতে তারা পরবর্তী জন্মে  চেঙ্গিস খানকে সঙ্গ দিতে পারে-এই বিশ্বাসে।

ইতিহাস আরও বলছে, মৃত্যুরেআগে   চেঙ্গিজ খান  নিজের সমাধিস্থল নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন, মঙ্গোলিয়ার খেন্তি পর্বতমালার ‘বুরখান খালদুন’ নামে এক  পর্বতের পাদদেশের কোনো এক বড় বৃক্ষের নিচে তার সমাধিক্ষেত্র। আবার অনেক ইতিহাসবিদের মতে ,তার সমাধিক্ষেত্র কোনো এক নদীর আশেপাশে কিংবা নদীর কোনো এক অগভীর রয়েছে। আবার কেউ  বলেন , তাকে সমাধিস্থ করার পর সমাধির ওপর দিয় শত শত ঘোড়া দৌড়িয়ে নেওয়া হয় ,যাতে তার কবরের উঁচু অংশ চিহ্নিত না করা  যায় এবং সেখানে বৃক্ষ রোপণ করে দেওয়া হয়।  

তবে এখানো চেঙ্গিসজ খানের বিশাল সাম্রাজ্যের অগণিত স্থানকে তার সমাধিক্ষেত্র হিসেবে সন্দেহ করছেন ইতিহাসবিদেরা। কিছু কিছু ইতিহাসবিদরা বেশ জোরেশোরেই বলেন,চেঙ্গিজ খানের  সমাধি মঙ্গোলিয়ায় কোন এক দুর্গম পাহাড়ে অবস্থিত।  আবার কারো  দাবি, চেঙ্গিস খানকে চীনে সমাধিস্থ করা হয়েছিল এবং এখানেই তার মৃত্যু হয়েছিলো। অবশ্য এই ধারণা খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না।

১৫০০ শতকের এক ফরাসী পাদ্রী চেঙ্গিস খানের সমাধির বিষয়ে দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, বুরখান খালদুন পর্বতের কাছের দুটি নদী আছে। একটির নাম  ‘খেরলেন’ এবং অপরটি “ব্রুচি”। এই দুই নদীর সংযোগস্থল  সম্ভাবনাময় একটি জায়গা। কারণ, এখানেই চেঙ্গিস খানের শৈশব-কৈশোর কেটেছে।কোনো এক যুদ্ধে জয়লাভের করার পর চেঙ্গিজ খান বলেছিলেন ‘এই জায়গাটি চিরকালই আমার প্রিয় রবে’- দাবি করেন এই ফরাসি পাদ্রী।

‘খেরলেন’ নদী খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু “ব্রুচই” এর কোন চিহ্নও এখন আর নেই। তাই চেঙ্গিজ খানের সমাধিক্ষেত্র অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে, সেইসঙ্গে অধরা হয়ে আছে মধ্য যুগের সবচেয়ে বড় গুপ্ত-ধনের সম্ভাব্য ভাণ্ডারটি।

চেঙ্গিস খানের সমাধিক্ষেত্র আবিস্কারের জন্য ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সালের মাঝে চেঙ্গিজ খানের সমাধি খোঁজার উদ্দেশ্যে একটি জাপানি বিশেষজ্ঞ দল উপগ্রহ ও ম্যাগ্নেটোমিটার ব্যবহার করে অভিযান চালায়, কিন্তু সেই অভিযান ছিল নিস্ফল। এরপর ২০০০ সালে আবারো ‘মরি ক্রাভিটস’ এর নেতৃত্বে আমেরিকা ও মঙ্গোলিয় একটি যৌথ দল  এনিয়ে অভিযানে নামে।  ২০০১ সালে একটি চমকপ্রদ তথ্য উদঘাটন  করে ক্রাভিটস এর দলটি। তারা ‘খেরেম’ নামক একটি স্থানের সন্ধান পায় যাকে চেঙ্গিজের দেয়াল বলা হয়ে থাকে। তাদের মতে, এখানেই সমাধি থাকার অনেক সম্ভাবনা দেখছিলেন তারা। তবে ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত দলটি ছিল পুরোপুরি নিশ্চুপ। এরপর আর খেরেম সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়নি দলটি। ২০০৬ সালে আবারো শুরু হয় খননকাজ। খুঁজে পাওয়া যায় ৩৯ টি সাধারণ কবরের উপস্থিতি। কিন্তু খানের  সমাধির খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। ফলে এনিয়ে রহস্য রয়েই গেছে।