আয়না২৪ ডেস্ক
সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাত বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আর এতে বাড়ছে মৃত্যুর হারও । প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে । বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই এমন অস্বাভাবিক বজ্রপাত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে।
গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বজ্রপাতের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো- বাতাসের মাধ্যমে ঘন কালো মেঘ এবং মাটিতে থাকা নেগেটিভ ও পজেটিভ চার্জে পরিবাহী হওয়া, বনাঞ্চল উজাড় করা, জলবায়ুর পরিবর্তন, জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, অত্যধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার ও গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধি।
আবহাওয়াবিদ ও বজ্রপাত বিষয়ক বিজ্ঞানী আব্দুল মান্নান বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই সাধারণত বজ্রপাত হয়। এ ছাড়াও উপরের কারণগুলোর জন্য বজ্রপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসের তাপমাত্রা স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। এ কারণে বজ্রপাতের পরিমাণও এই সময় বেশি থাকে।
বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘সায়েন্স’ এর এক প্রবন্ধে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় বজ্রপাত বিষয়ক গবেষক ডেভিড রম্প বলেন, জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, অত্যধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার ও গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধির কারণে ভূ-মণ্ডলে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। এই গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ওজোন স্তর এবং মিথেনের মতো ক্ষতিকর গ্যাসও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তখন বজ্রপাতের হার কমতে পারে।
এই শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনটি হলে বজ্রপাতের হার আরো বাড়তে পারে। রম্প বলেন, ২০০০ সালে যেখানে বছরের একটি নির্ধারিত সময়ে দুইবার বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে, সেখানে এখন ওই একই সময়ে তিনবার বজ্রপাত হচ্ছে। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের হার বাড়ে ১২ শতাংশ।
বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঝুঁকি ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। বজ্রপাতের কারণে গত সাত বছরে ১ হাজার ৭৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে চলতি বছরের গত ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে ২২ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া, ডিজাস্টার ফোরাম নামের বেসরকারি সংস্থার হিসাব মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারা দেশে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৭২২ জন।
বুয়েটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, আগে সাধারণত তালগাছ, নারিকেলগাছ ইত্যাদি গাছপালায় বজ্রপাতের ঘটনা বেশি লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু এখন অনেক সময় সরাসরি মানুষের ওপরই আঘাত হানছে। বাংলাদেশে হাওর অঞ্চলকে এখন বজ্রপাতের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কারণ গত কয়েক বছরে সুনামগঞ্চ, হবিগঞ্চ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বেশি।
এক শতাংশ তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ৭ শতাংশ বেশি জলীয়বাষ্প ধরতে পারবে। এরকম ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লে ১২ শতাংশ বেশি বজ্রপাত হবে। এই শতাব্দীর শেষে ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই হিসেবে বর্তমানের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি বজ্রপাত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বৈরী আবহাওয়া দেখলে নিরাপদ অবস্থান গ্রহণ করা শ্রেয়। দ্রুত ফাঁকা জায়গা ত্যাগ করা, কোনো ধরনের গাছগাছালির নিচে অবস্থান না করা, উঁচু ভবনের ফাঁকা ছাদে না থাকা অপেক্ষাকৃত নিচু ঘরে অবস্থান করা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হতে পারে। তবে অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাত থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায় হলো সচেতনতা। যখনই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে মেঘের গর্জন হবে তখন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে।
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে বজ্রপাতের সময় মাঠে কাজে যায়, নদীতে মাছ ধরতে যায়, গরু আনতে মাঠে যায় আবার বাচ্চারা খেলতে যায়। এটা মোটেও করা যাবে না। সারা দেশে যদি এই সচেতনতা করে তোলা সম্ভব হয় তাহলে বজ্রপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, আকাশে দুটি মেঘখণ্ড বা দুটি বরফখণ্ড পরস্পর সংঘর্ষের ফলে বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। কখনো কখনো এটি ভূ-মণ্ডলে নেমে আসে। সাধারণত এই ঘটনা বজ্রপাত নামে পরিচিত। এই বজ্রপাতের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে মে মাসে। মেঘরাশিতে সৃষ্ট এই বিদ্যুৎ আকাশেই শেষ হয়। তবে কখনও কখনও মাটি পর্যন্ত আসায় প্রাণহানিও ঘটায়।