প্রান্তিক জসীম
প্রধান কো-অর্ডিনেটর
হোপ বরগুনা
HopeBarguna.org
আরমান খান সানি(২২)। এতোটুকু ছেলেটার দায়িত্বশীলতা, দৃঢ়তা, মানবিক গুণাবলী সত্যি আশাবাদী করে তুলেছে আমায় ।
গেল ২৬ মার্চ থেকে করোনায় কর্মহীন গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য দেশের দক্ষিণের জেলা বরগুনায় আমাদের প্রচেষ্টায় উঠেছিল ‘হোপ বরগুনা’ নামে একটি মানবিক প্লাটফর্ম। আমাদের বন্ধু, সতীর্থ শুভাকাংখী ও নিজেদের সহযোগিতায় সংগঠনটি আজ ৪৩ দিন ধরে একটানা অসহায় মানুষের খাদ্য সহায়তা, শিশু, গর্ভবতী নারীদের পুষ্টিকর খাবার, অস্বচ্ছল পরিবারের কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন সুরক্ষা সামগ্রি বিতরণ, ইফতার সামগ্রি, রান্না করা ইফতার সামগ্রি, বৃদ্ধদের চিকিৎসা সহায়তায় অর্থ প্রদান, পথ কুকুরদের রান্না করা খাবার বিতরণসহ ১১ টি প্রকল্পে সহায়তা কার্যক্রম চালাচ্ছে। একদল উদ্যমী তরুণ-তরুণী ঘুরে ঘুরে এই সহায়তা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আরমান খান সানি সেই তরুণ ‘হোপ ম্যাসেঞ্জারদের’ দলনেতা্। করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি আতংকে যখন মানুষ গৃহবন্দী তখন এই অদম্য তরুণ সানির নেতৃত্বে দিন-রাত মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে খাদ্যসহ বিভিন্ন রকমের সহায়তা পৌছে দিচ্ছে তারা। ঝড়-বৃষ্টি, বৈরী আবহাওয়া কোনো কিছুই সানি ও তার দলকে দমাতে পারেনি।
শুক্রবার দুপুরে সানির নানি বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…)। সানি ও তার দল তখন বরগুনা শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে খেজুরতলা গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাদ্য সহায়তা পৌছে দিচ্ছিল। সতীর্থদের কাছে তার নানির মৃত্যুর খবর পৌছানো হলো। সানিকে তার সতীর্থদের একজন বললো, ‘দ্রুত ফিরতে হবে’। সানির প্রশ্ন ‘কেন? আকাশ তো ঝকঝকে রোদে ভরা। ঝড়-বৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই’। একজন বললো, ‘তার নানি অসুস্থ’। সানি সে সব অগ্রাহ্য করে বললো, ‘এই মানুষগুলোর ঘরে খাবার নেই। সেগুলো পৌছে না দিয়ে গেলে অন্যায় হয়ে যাবে’। সতীর্থরা বুঝলো সানি নাছোরবান্দা্।
তারা আমাকে ফোন করে বিষয়টি জানালো। এরপর বরিশাল থেকে ফোন করে সানিকে তার নানির মৃত্যুর খবর জানালাম। সানি কিছুটা বিমর্ষ হয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। তাকে বোঝানো হলো, এখন তার সেখানে যাওয়া উচিত। এরপর সানি ও হোপ ম্যাসেঞ্জাররা তার নানা বাড়িতে যায়। সেখানে অন্ত্যোষ্টির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় দুপুর ২ টায়। হোপ ম্যাসেঞ্জাররা এসব সেরেই ফিরে এসে কাজে লেগে যায়। ইফতারি তৈরি এবং তা বিতরণের প্রস্তুতি নেয়। তারা দুভাগ হয়ে একদল সানির নানা বাড়িতে ১৫০ জনের ইফতার নিয়ে গেল। আরেকদল নিয়মিত শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইফতার নিয়ে নেমে পড়ে।
নানির মৃত্যুতে সানি বিমর্ষ, শোকার্ত। কিন্তু সেই শোক তাকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। আজ শনিবার সকালে সে ঠিকই হোপ বরগুনার অফিসে হাজির। স্বেচ্ছাসেবকেরা সবাই বিষ্মিত। সানি সতীর্থদের আশ্বস্ত করে বললো, ‘যিনি চলে গেছেন তিনি তো গেছেনই। তাঁকে তো আর ফিরে পাবো না। কিন্তু যাঁরা বেঁচে আছেন এখন তাঁদের পাশে দাড়ানোই আামাদের সবচেয়ে বড় কাজ’। এবার সানি ফোন করলো আমায়, ‘ভাই আমি এসে পড়েছি- কাজ থামানো যাবে না। কারণ, এতোদিন মাঠে থাকায় অনেক মানুষ আমাদের ওপর ভরসা করে, অনেকে আমাদের অপেক্ষায় থাকে। আমরা কারও অসহ্য অপেক্ষার কারণ হতে পারি না’।
সানির কথা শুনে সত্যি মনটা আপ্লুত হলো। বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু বললাম, ‘ঠিক আছে’। ফোন ছেড়ে মনে মনে বলছিলাম, এই তরুণদেরই তো আমরা চাই-যাঁরা দেশকে, মানুষকে, মানবতাকে ভালবাসবে, কেবল নিজেকে নয়।