অনিন্দ্য আফরোজ
বাংলাদেশের অন্যতম একজন চারণ দার্শনিকের নাম আরজ আলী মাতুব্বর । বিংশ শতাব্দীতে এ দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে বরিশালের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত ছিলেন স্বশিক্ষিত এই দার্শনিক।
মানব জীবনকে অনুধাবন করতে গিয়ে আরজ আলী যুক্তিকে ব্যবহার করেছিলেন। জীবনে চলার পথে ধর্ম দিয়ে মানুষ নানাভাবে আকৃষ্ট হয়। মাতুব্বর অনুধাবন করেন যে ধর্মের অপব্যাখ্যা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বচ্ছ না করে কুসংস্কারপূর্ণ করে তোলে। যে জন্য জীবনে নানা ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এ কারণে তিনি সত্য কি তা আবিষ্কারের পথ ধরেন। জীবন ও বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের অন্তর্নিহিত সত্যকে তিনি খুঁজেছেন শুধু যুক্তি আর অসংখ্য প্রশ্ন করে তার উত্তর মেলানোর মধ্যদিয়ে । ১৯৮৩ সালে তিসি ‘অনুমান’ নামে একটি গ্রস্থ রচনা করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মূলত ‘অনুমান’ কোন তুচ্ছ বিষয় নয়। এর আশ্রয় না নিয়ে মানুষের এক মুহূর্তও চলে না। অনুমান করার শক্তি ক্ষীণ বলেই ইতর প্রাণী মানুষের চেয়ে এত পিছনে এবং মানুষ এত অগ্রগামী তার অনুমান করার শক্তি প্রবল বলেই। ভবিষ্যতের চিন্তা মাত্রেই অনুমান, কতক অতীতেরও। আর ভবিষ্যত ও অতীত বিষয়ের চিন্তা ও অনুমান করতে পারে বলেই মানুষ ‘মানুষ’ হতে পেরেছে’।
আরো পড়ুন…..দুনিয়া পাল্টে দেওয়া দার্শনিক অ্যারিস্টটল
আরজ আলীর জন্ম ও জীবন
আরজ আলী মাতুব্বর ১৯০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বরিশালের চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামচড়ি গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর বাবার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। আরজ আলী ছোটবেলায় গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করেন। পরে এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় প্রাথমিক শিক্ষা নেন। আর এটাই হল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
কিন্তু তিনি ছিলেন কঠোর যুক্তিবাদী। জীবন, দর্শন, জীবনাচার, ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে তাঁর মনের গভীরে ঘুরপাক খেত নানা প্রশ্ন। এজন্য তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন নিরন্তর। নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় তিনি লেখাপড়া শিখতে থাকেন। জ্ঞান পিপাসা মেটাতে তিনি বাড়ি থেকে ১১ কিলোমিটার হেঁটে বরিশাল শহরে যেতেন। তিনি বরিশালের ঐতিহাসিক ব্রজমোহন কলেজ গ্রন্থাগার ও গণগ্রন্থাগারে সমস্ত বাংলা বই একজন মনোযোগী ছাত্রের মত পড়তে থাকেন।আরজ আলীর তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল দর্শন । কিন্তু কলেজের পাঠাগারে পর্যাপ্ত বই না থাকায় বিএম কলেজের দর্শনের এক শিক্ষক – কাজী গোলাম কাদির তাঁর জ্ঞানগর্ভ বিচার দেখে মোহিত হন। তিনি পাঠাগার থেকে বই ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এভাবেই তাঁর মানসিক আকৃতি গঠিত হয়। তিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর জ্ঞান অর্জন করেন। আর এই জ্ঞানের সারগর্ভ দিয়ে তিনি রচনা করেন বেম কয়েকটি গ্রস্থ। এতে ধর্ম, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে।
আরো পড়ুন….খলিল জিবরানঃ আত্মা ও হৃদয় জাগরণের পঙক্তি
কৃষিকাজ ছিল তাঁর পেশা। অবসর সময়ে তিনি জমি জরিপ কাজ করতেন। তিনি আমিনি পেশার সূক্ষ্ম গাণিতিক ও জ্যামিতিক নিয়ম সম্পর্কে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন।
শৈশবে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার কারণে গ্রামের মানুষ তাঁর মায়ের জানাজা পড়তে রাজি হয় নি। শেষে বাড়ির কয়েকজন লোক মিলে তাঁর মায়ের দাফন করেন। এমন ঘটনা আরজ আলীর ধর্মীয় গোঁড়ামী ও কুসংস্কার বিরোধিতা এবং সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে উঠার পেছনে কাজ করে। এতে নানা প্রতিকূলতা ও সামাজিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তাতে তিনি থেমে যাননি। যুক্তি আর নানা প্রশ্নের জবাব মেলাতে তিনি আমরণ চেষ্টা চালান। তাঁর এসব যুক্তি ও নানা প্রশ্নের সম্ভার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তিনখন্ডের ‘আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র’।
‘আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরি’ প্রতিষ্ঠা
চরম প্রতিকূলতার মধ্যেই নির্ভৃত লামচরি গ্রামে বেড়ে ওঠা স্বশিক্ষিত আরজ আলী ১৯৮০ সালে নিজের অর্থে গড়ে তোলেন ‘আরজ মঞ্জিল গ্রন্থাগার’। নিজ অর্থে একতলা ছোট্ট একটি ভবন (দৈর্ঘ্যৈ ১৭ বর্গফুট প্রস্থে ১৬ বর্গফুট)। ৩০০ বই নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গ্রন্থাগারের। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর ৩৪ বছর কেটে গেলেও গ্রন্থাগারটির কলেবর, অবকাঠামো, আসবাব কিছুই বাড়েনি। ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ তিনি মৃত্যু বেরণ করেন।
রচনা সমূহ
তার লিখিত বইয়ের মধ্যে ‘সত্যের সন্ধান’, ‘সৃষ্টি রহস্য’, ‘সীজের ফুল’, ‘শয়তানের জবানবন্দী’ অন্যতম। আরজ আলীর রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি। এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯৭৩), ‘সৃষ্টি রহস্য’ (১৯৭৭), ‘অনুমান’ (১৯৮৩), ও ‘স্মরণিকা’ (১৯৮৮)।
সম্মাননা অর্জন
শিক্ষা বলতে গ্রামের মক্তবে কিছুকাল পড়াশোনা করেন তিনি।যেখানে শুধু কোরান ও অন্যান্য ইসলামিক ইতিহাসের উপর শিক্ষা দেয়া হতো। তিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। ধর্ম, জগত ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। তিনি তাঁর ৮৬ বছরের জীবনকালে ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন পড়াশোনা করে। জ্ঞান বিতরণের জন্য তিনি তার অর্জিত সম্পদ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। তিনি বাংলা একাডেমি’র আজীবন সদস্যপদ (১৯৮৫), বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৭৮) ও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর (বরিশাল শাখা) সম্মাননা (১৯৮২) লাভ করেন।
বর্তমান অবস্থা
বরিশাল নগর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে নিভৃত এক গ্রামের নাম লামচরি।কীর্তনখোলা নদী পাড়ের এই গ্রামেই জন্ম চারণ দার্শনিকখ্যাত আরজ আলী মাতুব্বরের।
নির্জন লামচরি গ্রামে আরজ আলীর বাড়ির পাশে ‘আরজ মঞ্জিল’ লাইব্রেরির সামনে নির্মাণ করা সিমেন্টের পিলারের ওপর যেনতেন করা ফটক। ফটকের ওপরে আরজ মঞ্জিল লেখা।ভেতরে ঢুকে বাঁ পাশে আরজ আলীর স্ত্রী বেগম সুফিয়া আরজের সমাধি ও তাঁর সমাধির ‘রিপ্লেকা’ (আরজের মরদেহ মেডিকেল দান করে গেছেন)। এর সামনেই আরজমঞ্জিল গ্রন্থাগার।
আরজ মঞ্জিল গ্রন্থাগারটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ছোট্ট একটি একতলা জরাজীর্ণ ভবন যেটি আরজ আলী মাতুব্বর নিজের জীবদ্দশায় নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে ৩০০ মত বই, চারটি চেয়ার, ছোট্ট একটি কাঠের টেবিল এই নিয়ে গ্রন্থাহারটি চালাচ্ছেন তাঁর ছেলের ঘরের নাতি শামীম আলী মাতুব্বর।সেলফে কিছু বই সাজানো। পাশে আরজ আলীর ব্যবহৃত প্লাস্টিকের জুতা, চায়ের কাপসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে ছোট্ট একটি কাঠের সেলফে। আছে আরজ আলীর হাতে লেখা একটি পাণ্ডুলিপি।
বাণী
“ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমন্ডলে আবদ্ধ হলে চলেনা। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে। ”
“বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে, জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই; জ্ঞান, ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন”