এপিজে আবদুল কালামঃ এক স্বপ্নবাজ কিংবদন্তী

ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯
Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

এ পি জে আবদুল কালামের পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুল আবেদীন। তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ভারতের ১১ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।পদার্থবিদ্যা এবং মহাকাশ প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়ন করা কালাম ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামশ্বরমে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি  প্রায় চার দশক ধরে ভারতের শীর্ষ ডিফেন্স রিসার্চ  অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট এবং ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনে একজন বিজ্ঞানী ও পরে  প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর। তামিলনাড়ু রাজ্যের রামশ্বরমের এক গরীব পরিবারে জন্ম  কালামের। বাবা  জয়নুল আবেদীনের উপার্জনের একমাত্র সম্বল হিসেবে ছিল মাত্র একটি ডিঙি নৌকা। এর আয়েই চলতো পুরো পরিবার।

ছোটবেলা থেকেই পরিবারের টানাপোড়েন আর কঠিন দারিদ্র্য পরিস্থিতি  আবদুল কালামকে  দক্ষ পরিশ্রমী মানুষের পরিণত করে। পরিবারের আর্থিক অনটন ঘোচাতে  মাত্র ৫ বছর বয়সেই ক্লাসের পড়াশোনা শেষে সন্ধ্যায়  তিনি শুরু করতেন পত্রিকা বিক্রির কাজ। কাজের জন্য কখনোই তিনি  পড়ালেখার বিঘ্ন ঘটাতেন না। বরং সবকিছুতেই  তিনি গভীর মনোযোগী ছিলেন।

কঠোর পরিশ্রমী কালাম তামিলনাড়ু রাজ্যের তিরুচির এলাকার সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এক বছর পর ১৯৫৫ সালে তিনি চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হন। তাঁর পছন্দের বিষয় ছিলো পদার্থবিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্র। পড়াশোনা শেষে আবদুল কালাম দুটি চাকরির  সুযোগ পান। একটি বিমান বাহিনীতে এবং অপরটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তবে  কালামের স্বপ্ন ছিলো মিলিটারী বেইজের একজন ফাইটার পাইলট হওয়া।

নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে পরে তিনি  লিখেছিলেন এভাবে, ‘বছরের পর বছর ধরে আমি স্বপ্ন দেখতাম আমি একটি উড়ন্ত যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্ট্রাটোস্ফিয়ারের স্তরে চষে বেড়াচ্ছি যা উড়তে থাকবে সেই উচ্চ সীমানায়’।

পরিবারের সাথে আবদুল কালাম আজাদ (বা থেকে চতুর্থ) 

স্বপ্নবাজ কালাম প্রথমে  ছুটে গেলেন দেরাদুন বিমান বাহিনীর অধীনে ইন্টারভিউ দিতে।  ডিটিডিপি’র (Directorate of Technical Development and Production) এর ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় কালাম খেয়াল করলেন বিমানবাহিনীতে শিক্ষা এবং দক্ষতার পাশাপাশি শারিরীক সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে তাঁরা চাইছিল হ্যাংলা পাতলা প্রার্থীর চেয়ে স্বাস্থ্যবান প্রার্থীকেই বেছে নিতে।

ফলাফলও তেমরই হলো। মাসে ৯ জন  প্রার্থীর মধ্যে ৮ জনই নির্বাচিত হলেন কেবল বাদ পড়লেন আব্দুল কালাম। এতে খুব ভেঙে পড়েন কালাম। কারণ চোখের সামনেই নিজের স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেখা সহজ ছিল না তাঁর। কালাম জীবনে অনেক প্রতিকূলতা দেখেছেন তবে এতদূর এসে তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়া খুবই কষ্টকর। ভগ্ন মন নিয়ে তিনি হৃষীকেশ ফিরে যান। সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ পেলেন স্বামী শিবানন্দের।

কালাম স্বামীজীকে তাঁকে সব খুলে বলার পর স্বামীজী তাঁকে পরামর্শ দেন ভরসা না হারাতে। স্বামীজীর কথা শুনে তিনি পুরো উদ্যম ফিরে পান। এরপর কালামের বার বার মনে পড়তে থাকে স্বামীজীর কথা।  স্বামীজীর কথা পরে আত্মজীবনীতে কালাম লিখেন এভাবে,  আজকের ব্যর্থতা ভুলে যাও, তার বদলে তোমার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যের অনুসন্ধান করো। এয়ারফোর্স পাইলট হওয়া তোমার নিয়তি নয়। নিজের সঙ্গে একাত্ম হও, আত্মসমর্পণ কর ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে’।

আরো পড়ুন…ঠিক কর, কীভাবে নিজেকে স্মরনীয় করে রাখবে- এ পি জে আবদুল কালাম

এবার কালাম ফিরে আসেন দিল্লীতে। সেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাক্ষাৎকারের ফলাফল জানতে চলে যান। কিন্তু এবার ভাগ্য বিড়ম্বিত হল না বরং  সহায় হল। তিনি হাতে পেলেন  অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। এবার আর পেছনে তাকান নি তিনি বরং  ডিটিডিপির চাকরিতে মনোনিবেশ করেন জ্যেষ্ঠ সায়েন্টিফিক  অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে।

সমৃদ্ধির শুরু

আবদুল কালামের জীবনের শুরু হয়েছিল  ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য ছোট একটি হেলিকপ্টার তৈরির মধ্য দিয়ে।

ডিটিডিপিতে বছর তিনেক কর্মজীবন শেষে  অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হলে আবদুল কালামকে সেখানে নেওয়া হল।

পরিকল্পনা হলো ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তির সাহায্যে হোভারক্রাফট তৈরির। কিন্তু এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ালো  নির্মাণ সামগ্রীর অপ্রতুলতা। হোভারক্রাফট এমন একটি বাহন যা মাটি, পানি এবং বরফের ওপর অনায়াসে চলতে পারে। তখনকার যুগে এশিয়া মহাদেশে এই ধরণের বাহন তৈরির সিদ্ধান্ত পুরোটাই দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হতো। হোভারক্রাফট নির্মাণের নকশা। এই বাহন তৈরির পরিকল্পনার নকশা বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা দলটির প্রধানের দায়িত্ব পড়ে  কালামের ওপর।

কর্মব্যস্ত কালাম

কিন্তু কালাম যখন এখানে দায়িত্ব নিলেন তখন বাস্তবতা অন্যকিছু হয়ে ধরা দেয়। সমীক্ষা চালিয়ে দেখলেন, এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নের সক্ষমতা দলটির সাধ্য অতিক্রম করবে। কারণ হোভারক্রাফট নির্মাণ তো পরের কথা বরং একটি অন্য মেশিনকে সম্পূর্ণরুপে কাঠামোতে দাঁড় করানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কেউই দেশে যেমন ছিল না। পাশাপাশি এই বাহন নির্মাণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব ছিল।

এতোকিছুর শ্যন্যতার মধ্যেও  দমে যাওয়ার পাত্র নন কালাম। বরং যা আছে তা নিয়েই নেমে পড়লেন তিনি। তিনি জানতেন  কিছু করতে না পারলে গ্রাম থেকে উঠে আসা নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি ছেলেরপক্ষে  টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। শত বাধাবিপত্তি, হেনস্তা সহ্য করে তিনি এগিয়ে চললেন তাঁর সংকল্প বাস্তবে রূপ দিতে।  প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য তাঁকে সময়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তিনি কাজে লেগে গেলেন। সফলতাও পেলেন অবিশ্বাস্যভাবে। মাত্র দু বছর ছয় মাসের মাথায় তাঁর দল কাজটি সম্পন্ন করে ফেললেন। নিজ দেশে নির্মিত ৪০ মিলিমিটারের হাওয়ার গদির ওপর ৫৫০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি হোভারক্রাফট নির্মাণ করলেন আর এর নাম রাখা হলো,‘নন্দী।‘ তবে সামরিক খাতে ব্যবহারের জন্য  হোভারক্রাফটি নির্মাণ করা হয়েছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি.কে.কৃষ্ণ মেননের পৃষ্ঠপোষকতায়। তবে দুর্ভাগ্যই যে তিনি মন্ত্রীত্ব হারানোর পর প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা হারায়। এতো পরিশ্রমের মাধ্যমে তৈরি নিজের সৃষ্টকর্মের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভাবিয়ে তোলে আব্দুল কালামকে।

মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া

হোভারক্রাফট প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতয় পড়ার পর কালাম নিজেকে এতোটা ভেঙে পড়তে দেন নি। কারণ, দৃঢচেতা কালাম  বিশ্বাস করতেন পরিশ্রম কখনো বিফ্যেল যায় না।  এমন আত্মবিশ্বাস নিয়েই তিনি এগিয়ে চললেণ।  বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ তাঁকে জানানো হলো তাঁর ল্যাব পরিদর্শনে আসছেন  উচ্চপদস্থ   কোনো ব্যক্তি। ওই ব্যক্তির  উপস্থিতিতে যেন তাঁর তৈরি হোভারক্রাফটটির পরীক্ষামূলক চলাচলের ব্যবস্থা করেন তিনি। খবর শুনে আশান্বিত হয়ে ওঠেন কালাম। তিনি সেই মাফিক ব্যবস্থাও করে রাখলেন। এরপর উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তাঁর  ল্যাব পরিদর্শনে এলেন।  হোভারক্রাফটে চড়ে বেড়ালেন এবং কালামের কাছ থেকে প্রকল্পের বিষয়ে নানা বিষয় জেনে নিলেন। পরিদর্শক চলে যাওয়ার পর কালাম  জানতে পারলেন তিনি ছিলেন টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর ডিরেক্টর এম জি কে মেনন। বিস্ময়ের শেষ এখানেই নয়, বরং  এক সপ্তাহ পর আব্দুল কালামের ডাক পড়ে টিআইএফআর এর বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান ‘INCOSPAR’ থেকে। তাঁকে ডাকা হল রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং পদের চাকরির জন্যে। কা্লাম  বুঝতে পারলেন এটা শুধু ইন্টারভিউ নয় বরং পরীক্ষকেরা তাঁকে যাচাই করতে চাইছেন যে তাঁর ভেতরে কোন বৃহত্তর পরিকল্পনার সম্ভাবনা লুকায়িত  আছে কি না। তিনিও বিনয়ের সঙ্গে বিস্তারিত  জানালেনও। পরেরদিনই তিনি জানতে পারলেন তাঁর চাকরি নিশ্চিত। ওই সময় এমন চাকরি ছিল স্বপ্নের মতই। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন এবং  ড. ভিক্রাম সারাভাইয়ের অধীনে কাজ শুরু করেন।

 

সেটা ১৯৬০ সালের কথা। ডিআরডিওতে একজন প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না কালাম। এখানে বেশ কয়েক বছর  কাজ করার পর কালাম ১৯৬৯ সালে যোগ দেন ভারতীয় স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনে (আইএসআরও)। এই  সংস্থাটি  স্যাটেলাইট সম্পর্কিত গবেষণা করে। সেখানে তিনি স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান। এখানে তাঁর অধীনে বেশ কয়েকটি প্রকল্প সাফল্য পায়।  এর পরিপ্রেক্ষিতে ৭০ এর দশকে ‘প্রজেক্ট ডেভিল’ ও ‘ভ্যালিয়ান্ট’ নামে দুটি প্রকল্প হাতে নেন কালাম। ভারত এই প্রকল্পের মাধ্যমেই  ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় পায়। আর সেটা আসে  আব্দুল কালামের হাত ধরেই।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সফলতার পর আরপেছনে ফিরে তাকান নি আবদুল কালাম। দুটি ক্ষেপণাস্ত্র  সফলভাবে উৎক্ষেপণের পর কালাম এসএলভি প্রকল্পেও সফলতা পান। এসএলভি রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপিত হয় রোহিনি – ১ নামের মিসাইলটি। ভারতকে এই মিসাইল  উৎক্ষেপণের মধ্যদিয়ে  বিশ্বব্যাপি স্বীকৃতি এনে দেয় । আর  তা  অর্জিত হয়  এ পি জে আব্দুল কালামের মাধ্যমেই। ভারত সরকার তাঁর এই সফলতায় খুশি হয়ে  ‘অগ্নি’ এবং ‘পৃথ্বী’ নামের যে বর্তমান পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রকল্প সেটিও কালামের হাতে তুলে দেয়।

কিন্তু কালাম ‘মিসাইল ম্যান’ হিসেবে খ্যাতি পান আরও অনেক পরে। অর্থ্যাৎ ১৯৯২ সালে। ওই বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর এবং প্রতিরক্ষা গবেষণা  ও উন্নয়ন সংগঠনটির প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা  নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি এই পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব  পালন করেন। এই সময়ে তাঁর নেতৃত্বে  ‘পোখরান’ – ২ পারমাণবিক পরীক্ষা  সফল হয়। এই সফলতার মাধ্যমেই তিনি ‘মিসাইল ম্যান’ খ্যাতি পান।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পুরষ্কার সম্মাননা

নিরামিষ ভোজী ও চিরকুমার এ পি জে আব্দুল কালাম ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি  নিযুক্ত হন ২০০২ সালে। ২০০২ থেকে  ২০০৭ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবেও তিনি যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তাঁর ঝুলিতে প্রায় সবধরণের বেসামরিক সম্মাননার পাশাপাশি রয়েছে সর্বোচ্চ সম্মাননা হিসেবে ১৯৮১ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ১৯৯০ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ১৯৯৭ সালে ‘ভারতরত্ন’ খ্যাতি। ১৯৯৭ সালে পান ‘ইন্দিরা গান্ধী’ সম্মাননা। এর পরের বছর পান ভারত সরকারের ‘বীর সভাকর’ সম্মাননা। চেন্নাইয়ের আলোয়ার রিসার্চ সেন্টার তাঁকে ‘রামানুজন’ সম্মাননা প্রদান  করে ২০০০ সালে। যুক্তরাজ্য রয়্যাল সোসাইটি থেকে ২০০৭ সালে দেওয়া হয় ‘চার্লস’ মেডেল।ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি তাঁকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ভন কারম্যান উইংস’ নামের সম্মাননায় ভূষিত করে ২০০৯ সালে। কালাম প্রায় ৪০ টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান সম্মাননাসূচক ‘ ডক্টরেট’। আর জাতিসংঘ  তাঁর ৭৯তম জন্মদিনে অনন্য সম্মান  হিসেবে ১৫ অক্টোবর তাঁর জন্মদিনকে ‘বিশ্ব শিক্ষার্থী দিবস’ ঘোষণা করে।

পি জে আব্দুল কালাম আজাদ এর সাহিত্যকর্ম

রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতে  পছন্দ করতেন খ্যাতিমান পরমাণুবিজ্ঞানী  কালাম। তাঁদের তরুণদের মনে আলো জ্বালাতে চাইতেন। জীবন থেকে নেওয়া সেই সব শিক্ষার কথা খুব সহজ করে বর্ণনা করে তরুণ অনুপ্রেরণা জোগাতেন। শুধু  বিজ্ঞান নয়, শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, বিচারব্যবস্থা-  সবকিছু নিয়েই তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতেন ।  এসব টুকরো টুকরো কথায় ছিল গভীর দর্শন। তা কাজে লাগানো গেল জীবনকে বদলে ফেলা সম্ভব। লেখক হিসেবেও কালাম তাঁর নিজস্বতার ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর ‘Wings of Fire’ বইটি অন্যতম বেস্ট সেলার। ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে এটি। আসলে যে পারে, সে সবই পারে।  কালাম এমন একজন মানুষ। একাধারে তিনি  বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপতি, সুবক্তা, লেখক। সর্বোপরি তিনি একজন সাদাসিদে ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর কিছু বিখ্যাত বই।

১। India 2020: A Vision for the New Millennium (1998)

২। Wings of Fire: An Autobiography (1999)

৩। Ignited Minds: Unleashing the Power within India (2002)

৪। The Luminous Sparks: A Biography in Verse and Colors (2004)

৫। Guiding Souls: Dialogues ln the Purpose of Life (2005)  

৬। Inspiring Thoughts: Quotation Series (2007)

৭। You are Born to Blossom: Take my journey Beyond (2011)

 

আরও পড়ুন- এ পি জে আবদুল কালাম কেন ইফতার পার্টি দিতেন না!

আবদুল কালাম আজাদের কিছু বাণী  – 

আবদুল কালামের কিছু টুকরো কথার মধ্যে গভীর জীবনবোধ ও  দর্শন লুকিয়ে আছে। যা  তরুণদের   জীবনের  লক্ষে পৌছাতে সাহায্য করে। আসুন এবার এমন কিছু বাণী জেনে নেওয়া যাক। 

. স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে। আর স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হল সেটাই যেটা পুরণের প্রত্যাশা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।

. তুমি তোমার ভবিষ্যত পরিবর্তন করতে পারবে না কিন্তু তোমার অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারবে এবং তোমার অভ্যাসই নিশ্চিত ভাবে তোমার ভবিষ্যত পরিবর্তন করবে।

. একটি ভাল বই একশত ভাল বন্ধুর সমান কিন্তু একজন ভাল বন্ধু একটি লাইব্রেরীর সমান।

. সফলতার গল্প পড়ো না কারন তা থেকে তুমি শুধু বার্তা পাবে। ব্যার্থতার গল্প পড় তাহলে সফল হওয়ার কিছু ধারনা পাবে।

. জাতির সবচেয়ে ভাল মেধা ক্লাসরুমের শেষ বেঞ্চ থেকে পাওয়া যেতে পারে।

. জীবন এবং সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ট শিক্ষক। জীবন শিখায় সময়কে ভালভাবে ব্যবহার করতে সময় শিখায় জীবনের মূল্য দিতে।

. তোমার কাজকে ভালবাস কিন্তু তোমার কোম্পানিকে ভালবাসো না। কারন তুমি হয়ত জান না কখন কোম্পানিটি তোমাকে ভালবাসবে না।

. তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো জ্বলো,

. ছাত্রজীবনে বিমানের পাইলট হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়ে, হয়ে গেলাম রকেট বিজ্ঞানী

১০. জীবন হলো এক জটিল খেলা। ব্যক্তিত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে তুমি তাকে জয় করতে পার।

১১. জটিল কাজেই বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। তাই সফলতার আনন্দ পাওয়ার জন্য মানুষের কাজ জটিল হওয়া উচিত।

১২. পরম উৎকর্ষতা হলো একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা হঠাৎ করেই আসে না। ধীরে ধীরে আসে।

১৩. যারা মন থেকে কাজ করে না, তাঁরা আসলে কিছুই অর্জন করতে পারে না। আর করলেও সেটা হয় অর্ধেক হৃদয়ের সফলতা। তাতে সব সময়ই একরকম তিক্ততা থেকে যায়। 

১৪. জীবন হলো একটি জটিল খেলা। ব্যক্তিত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে তুমি তাকে জয় করতে পার।

১৫. আমরা তখনই স্মরণীয় হয়ে থাকবো, শুধুমাত্র যখন আমরা আমাদের উত্তর প্রজন্মকে উন্নত ও নিরাপদ ভারত উপহার দিতে পারবো।

১৬. যদি কোন দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় এবং সবার মধ্যে সুন্দর মনের মানসিকতা গড়ে ওঠে, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি সেখানকার সামাজিক জীবনে তিন রকম মানুষ থাকবে, যারা পরিবর্তন আনতে পারেন। তারা হলেন পিতা, মাতা ও শিক্ষক। 

১৭. শিক্ষাবিদদের উচিত শিক্ষার্থীদের মাঝে অনুসন্ধানী, সৃষ্টিশীল, উদ্যোগী ও নৈতিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়া, যাতে তারা আদর্শ মডেল হতে পারে।

১৮. তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান হলো ভিন্নভাবে চিন্তা করার সাহস থাকতে হবে। আবিষ্কারের নেশা থাকতে হবে। যেপথে কেউ যায় নি, সে পথে চলতে হবে। অসম্ভবকে সম্ভব করার সাহস থাকতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে এবং তারপর সফল হতে হবে। এগুলোই হলো সবচেয়ে মহৎ গুণ। এভাবেই তাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। তরুণদের কাছে এটাই আমার বার্তা।

১৯. উত্কর্ষ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়।

২০. জীবন এক কঠিন খেলা। এই খেলায় জয় তখনই সম্ভব, যখন তুমি ব্যক্তি হিসেবে জন্মগতভাবে পাওয়া অধিকারকে ধারণ করবে।

২১. জীবনে সমস্যার প্রয়োজন আছে। সমস্যা আছে বলেই সাফল্যের এতো স্বাদ।

২২. যে হৃদয় দিয়ে কাজ করে না, শূন্যতা ছাড়া সে কিছুই অর্জন করতে পারে না।

২৩. শিক্ষাবিদদের বিচক্ষণতা, সৃজনশীলতার পাশাপাশি উদ্যোগী হওয়ার ও নৈতিক নেতৃত্বেরও শিক্ষা দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেকে পথিকৃত্ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যোগ্যতা অর্জন করা উচিত।

২৫. যদি একটা দেশকে সম্পূণর্রূপে দুর্নীতিমুক্ত ও একটা জাতিকে সুন্দর মনের অধিকারী করতে হয়, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, তিনজন ব্যক্তি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন- বাবা, মা ও শিক্ষক।

২৬. আমরা শুধু সাফল্যের উপরেই গড়ি না, আমরা ব্যর্থতার উপরেও গড়ি। 

২৭. একজন খারাপ ছাত্র একজন দক্ষ শিক্ষকের কাছ থেকে যা শিখতে পারে তার চেয়ে একজন ভালো ছাত্র একজন খারাপ শিক্ষকের কাছ থেকে অনেক বেশী শিখতে পারে ।

২৮. আকাশের দিকে তাকাও। আমরা একা নই। মহাবিশ্ব আমাদের প্রতি বন্ধুপ্রতীম। যারা স্বপ্ন দেখে ও সে মতো কাজ করে, তাদের কাছেই সেরাটা ধরা দেয়।

২৯. আমি আবিষ্কার করলাম সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেশী বিক্রি হয়ে যায় সিগারেট ও বিড়ি। অবাক হয়ে ভাবতাম, গরিব মানুষেরা তাদের কঠোর পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ এভাবে ধোঁয়া গিলে উড়িয়ে দেয় কেন।

৩০.আমি সুপুরুষ নই। কিন্তু যখন কেউ বিপদে পড়েন আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। সৌন্দর্য থাকে মানুষের মনে।

মৃত্যু

২০১৫ সালের ২৭ জুলাই। মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ‘বসবাসযোগ্য পৃথিবী’ বিষয়ে বক্তব্য রাখছিলেন আবদুল কালাম আজাদ। এসময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী। তাৎক্ষণিখ তাঁকে বেথানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি রোত পৌনে ৮ টায়  শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

আবদুল কালাম কেবলমাত্র ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি কিংবা ভারতীয় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির কিংবদন্তী নন, তিনি ভারতীয়দের কাছে একজন সন্ত (সাধু) হিসেবে বিবেচিত। তিনি সারাটা জীবনই ব্যয় করেছেন দেশে তথা মানুষের উন্নতির জন্য।  শিখিয়েছেন স্বপ্ন দেখতে  এবং  বিশ্বাস করতে। অসামান্য আধ্যাত্মিক চেতনার মধ্যদিয়ে তিনি এক সুতোয় গেঁথেছিলেন নানা ধর্ম, মতে বিভক্ত ভারতবাসীকে।

 আরও পড়ুন- ঠিক কর, কীভাবে নিজেকে স্মরনীয় করে রাখবে- এ পি জে আবদুল কালাম