অনিন্দ্য আফরোজ
নাদিয়া_মুরাদের নাম হয়তো অনেকেরই জানা। নাদিয়া ইরাকের ইয়াজিদি মানবাধিকারকর্মী হিসেবে খ্যাত হলেও তিনি আরো বেশি খ্যাতিমান হয়েছেন নোবেল জয় করে। এখন তিনি একজন বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী। বিশ্বশান্তিতে গেলবার তিনি নোবেল জয় করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়েছেন। কঠিন বাস্তবতার আর লোমহর্ষক নির্যাতনের নাগপাশ ছিন্ন করে ঘুরে দাঁড়ানো অদম্য নাদিয়া এখন সারা পৃথিবীর নির্যাতিত নারীদের অনুপ্রেরণা। আসুন আজ নাদিয়ার জীবন, সংগ্রাম এবং অদম্য হয়ে ওঠার কাহিনী জানবো।
নাদিয়া মুরাদের বয়স পঁচিশ। তিনিই প্রথম ইরাকি যিনি নোবেল জয় করেছেন। তবে এই জয়টা খুব সহজ আর মসৃণ ছিল না নাদিয়ার। ইরাকের সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের একজন লড়াকু নারী হিসেবে নাদিয়া প্রত্যক্ষ করেছেন পৃথিবীর নির্মমতম জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পৈশাচিক বর্বরতা। শিকার হয়েছেন অবর্ণনীয় নির্যাতন ও লাঞ্ছনার। ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম পাড় করে এসেছেন জয়ের দ্বারপ্রান্তে।
ভয়ঙ্কর জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের ভয়াবহ নির্মমতার জঘন্য অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করা এই অদম্য সাহসী তরুণী নাদিয়ার বাসস্থান উত্তর ইরাকের সিঞ্জারের পাহাড়ি এলাকায়। নিজের গ্রামে শান্তিময় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করেছেন তিনি। ২০১৪ সালে যখন আইএস জঙ্গিরা সিরিয়া এবং ইরাকে তাদের বিভৎস ত্রাস শুরু করে তখন থেকেই দুঃস্বপ্নের শুরু নাদিয়ার।
২০১৪ সালের আগস্টের ঘটনা। আইএস জঙ্গিরা কালো পতাকা বহনকারী একটি গাড়ি ঢুকে পড়ে নাদিয়ার গ্রামে। গ্রামে ঢুকে জঙ্গিরা শুরু করে তাদের নারকীয় নির্মমতা। পুরুষদের নৃসংশভাবে হত্যাযজ্ঞ, শিশুদের জঙ্গি বানানোর উদ্দেশে বন্দী এবং নারীদের জোরপূর্বক শ্রম ও যৌনদাসী হতে বাধ্য করে। নাদিয়াকে ধরে নিয়ে যায় আইএস জঙ্গিরা। শুরু হয় তাঁর ওপর নারকীয় নির্যাতন। এরপর আইএস জঙ্গিদের কাছে যৌনদাসী হিসেবে নাদিয়াকে বিক্রি করে দেয় জঙ্গিদের আরেকটি পক্ষ। সেখানে তাঁকে নিয়মিত প্রহার করা হতো । সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হতো শরীরের বিভিন্ন স্থান। যখনই তিনি পালানোর চেষ্টা করতেন তখনই তাকে ধর্ষণ করা হতো। এরপরের জীবন কতটা দুঃস্বপ্নমোথিত তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো ছিল না। সিরিয়া, ইরাক, তিউনিসিয়া ও ইউরোপিয় আইএস জঙ্গিদের নিষ্ঠুর লালসার শিকার হতে হয় নাদিয়াকে। নরক যন্ত্রণায় কেটেছে প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর।
কিন্তু এতো নিষ্ঠুরতায়ও দমে যাননি নাদিয়া। তিন মাস এভাবে দুঃসহ জীবন কাটিয়ে অদম্য নাদিয়া ওই বছরের নভেম্বরে অনেক কষ্ট-সংগ্রাম-কৌশলে জঙ্গিদের ডেরা থেকে পালান। তাঁকে আটকে রাখার দায়িত্বে যে ব্যক্তি ছিল একদিন তিনি তাঁর বন্দিশালায় ভুলে তালা না দিয়েই চলে যান। এই সুযোগে বন্দিশালা থেকে পালান নাদিয়া। তাঁকে আশ্রয় দেন প্রতিবেশী এক পরিবার। এরপর তারা আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে পালিয়ে উত্তর ইরাকের দুহোকে অবস্থতি একটি শরণার্থী শিবিরে গিয়ে ওঠেন ।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি প্রথম একটি বেলজিয়ান দৈনিক পত্রিকা লা লিব্রে বেলজিক’কে সাক্ষাতকার দেন নাদিয়া। তখন তিনি রোয়ান্ডায় একটি আশ্রয়শিবিরের একটি কন্টেইনারের ভেতর বসবাস করছিলেন। ২০১৫ সালে তিনিসহ এক হাজার নারী ও শিশুকে জার্মানির বাদেন-উরতেমবার্গ সরকার শরণার্থী কর্মসুচির অধীনে সুবিধা দিলে নাদিরাও সেখানে চলে যান। আর সেটাই হয়ে ওঠে নাদিয়া মুরাদের নতুন ঠিকানা।
পালিয়েই তিনি ক্ষ্যান্ত হননি। এরপর তিনি যোগ দেন আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দী ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের নির্যাতিত নারীদের মুক্তির যুদ্ধে। সোচ্চার হয়ে রুখে দাঁড়ান নারী পাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এতে তিনি পরিণত হন ইয়াজিদিদের মুক্তির সংশপ্তক যোদ্ধায়।এখন তিনি ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের নারীদের মুক্তির প্রতীক।
যৌন নিপীড়িন আর অমানসিক নির্যাতনের শিকার নাদিয়া কাজ শুরু করেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়সহ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের শরণার্থীদের আইনজীবী হিসেবে। মানবাধিকার আদায়ে এই ভূমিকার জন্য তাকে ইউরোপিয় পার্লামেন্টে সম্মানজনক শাখারভ পুরস্কার দেওয়া হয়।
২০১৫ সালে তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সামনে তুলে ধরেছিলেন নিজের ভয়ানক অভিজ্ঞতা সেই লোমহর্ষক ঘটনা। আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় তিন মাসের মাসের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ংকরের চেয়েও আরো ভয়ঙ্কর। জঙ্গিরা নাদিয়াকে তাদের স্বঘোষিত খিলাফতের রাজধানী মসুলে নিয়ে যায়। সেখানে তিন মাস তিনি বার বার গণধর্ষণ, বর্বর নির্যাতন এবং প্রহারের শিকার হন।
জাতিসংঘে নাদিয়া তাঁর বক্তৃতায় বলছিলেন, ” যখন আমাদেরবন্দী করা হয়, তখন ওদের (জঙ্গি) যৌন নির্যাতনের শোনা কথাগুলো স্মরণ করে মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম ওরা যেন আমাদের মেরে কিন্তু, ওরা আমাদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয় তাদেরই আরেকটি পক্ষের কাছে। এরপর কী যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে! প্রত্যেকটা মুহূর্তে মনে হয়েছে, আমাদের মেরে ফেলা হচ্ছে না কেন! কেনো আমাদের এভাবে তিলে তিলে নির্যাতন করা হচ্ছে?”
নাদিয়ার ভাষ্য, তিন হাজারের বেশি নারী আইএস জঙ্গিদের হাতে যৌনদাসী হিসেবে বন্দী রয়েছে। আইএস এই হতভাগ্যদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে! ইচ্ছেমতো জায়গায় বিক্রি করছে দিচ্ছে।
জঙ্গিরা নারী ও বন্দীদের দাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য ক্রীতদাস বাজার গড়ে তুলেছিল এবং একই সঙ্গে ইয়াজিদি নারীদের ধর্ম ত্যাগ করতে জন্য বাধ্য করছিল।
প্রসঙ্গত, তথাকথিত পৌত্তলিক ইসলামিক ধ্যান ধারণা অনুযায়ী জিহাদি জঙ্গিরা ইয়াজিদিদের কাফির গণ্য করে। কুর্দি ভাষী এই সম্প্রদায় একটি প্রাচীন ধর্মকে অনুসরণ করে। তাঁরা এমন এক একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করে যা তারা একটি প্রতীকী ময়ূরের মাধ্যমে উপস্থাপন করে।
পালানোর চেষ্টা
সহিংসতা, নির্মম যৌন নির্যাতনে হতভম্ব নাদিয়া এমন বিপর্যস্ত জীবন নিয়েও একটু দমে যাননি। বরং জঙ্গিদের কবল থেকে পালানো এবং বন্দী নারীদের মুক্তির জন্য চেষ্টা চারান। তিনমাস পর তিনি মসুল থেকে একটি মুসলিম পরিবারের সহায়তায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন । এসময় তিনি মিথ্যা পরিচয়পত্র নিয়ে ক্যাম্পের অন্যান্য বিচ্ছিন্ন ইয়াজিদিদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ইরাকের কুর্দিস্তানের দীর্ঘপথ অতিক্রম করেন। এখানেই, তিনি জানতে পারেন, তার মাসহ ছয় ভাইকে মেরে ফেলেছে জঙ্গিরা।
স্বজনদের মৃত্যুর খবরে তিনি ভেঙে পড়েন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। এরপর জন্মভূমিতে ফিরে ইয়াজিদিদের মিত্র একটি সংগঠনের মাধ্যমে তিনি জার্মানিতে পাড়ি জমান তাঁর বোনের কাছে। বর্তমানে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন।
তারপর থেকেই নাদিয়া তাঁর জীবনকে “আমার জনগণের যুদ্ধে” উৎসর্গ করেছেন। তাঁর সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে হন এবং অত্যাচারিত গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে যুদ্ধ শুরু করেন। এখনও তিনি নিখোঁজ ও নির্যাতিত ইয়াজিদিদের জন্য তাঁর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
নাদিয়া ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধেও কঠিন ভূমিকা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে। যা তাঁকে নোবেল পুরস্কারে গৌরব এনে দিয়েছে।