সাজেক উপত্যকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সতেরশ ফুট উচ্চতায়- যেন রাঙামাটির ছাদ। সাজেকের কংলাক চূড়া থেকে মেঘমুক্ত সময়ে দূর থেকে তাকালে পাহাড়ের বন্ধন পেরিয়ে চোখে পড়ে কাপ্তাই লেকের সুবিশাল জলধারা। ক্যামেরার লেন্স নয় চোখের রেটিনায় ধরা দেবে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
কংলাকের অন্য পাশে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সীমানা ছুঁয়ে থাকা গভীর বন। বন থেকে ক্রমশ এখানে অরণ্যের ডানা আকাশ ছুঁয়েছে। নিবিড় বন কাচালং রির্জাভ ফরেস্টের অংশ। তরু পল্লবের ছায়ায ঘেরা আমাদের সাজেক-কংলাক।সাজেকের পথে এবারের যাত্রাটা নদীপথ ধরে, নীল জল ছুঁয়ে পাড়ি দিব কাপ্তাই লেক। যাত্রার শুরুটা রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে।
তখনও ভোরের আলোয় আড়মোড়া ভাঙেনি প্রকৃতি। দূরের পাহাড় ছুঁয়ে আছে লেকের টলমল জলের বুকে কত শত জলজ প্রাণী। হলুদ পাহাড় থেকে ঝরছে সোনালি আলোর ধারা। নীলকাশে মেঘ-রৌদ্দুর হাওয়ায়- লঞ্চে চড়ে রওনা হলাম শান্ত জলের ধারায়। সহযাত্রীদের রাতে ক্লান্তি যেন কেটে গেল নীল জলের মুগ্ধতায়। জলের ধারা ভেঙে ভেঙে অভিযাত্রীর দল ছুটল লংগদু পথে।এখানে হাতের রেখার মতো ছোট ছোট দ্বীপ ছড়িয়ে আছে জলের চারপাশে। যেন জলদ্বীপের মাঝখানে ছোট ছোট বসতি। পানকৌড়ির ঝাঁকে কয়েকটা সারস পাখিও উড়ছে পানির উপর।
সবুজ পাহাড়, স্বচ্ছ পানি, নীল আকাশের বাহারি রংয়ের পসরা। জলের পথে একে একে পেরিয়ে যাচ্ছি ছোট্ট দ্বীপ। বিহার, বাজার, জেলেদের মাঝ ধরার ঘাট, পাথুরে পাহাড়।শুভলং বাজারে কিছুক্ষণের বিরতি পেরিয়ে আবার যাত্রা হল গভীর লেক ধরে। বিস্তৃত লেক চারপাশে। অনেকাংশে জলের সীমানাটুকু চোখ এড়িয়ে যাই। বসন্তের সকাল প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হবে যে কেউ, লেকের পাশের প্রাকৃতিক বনজুড়ে হলুদ রংয়ের ক্যানভাস।
নীল জল ছুঁয়ে আছে দ্বীপগ্রাম কাট্টলি বিল, ছোট ছোট দ্বীপ, নিঃশব্দের জলাভূমিতে জেগে আছে কাট্টলি বিল বাজার। কাট্টলি বিল পেরিয়ে আমাদের লঞ্চ নোঙর করে লংগদু ঘাটে। লংগদু নেমেই মধ্যাহ্নভোজের পর্ব শেষ করি।লেকের তীরে সবুজ জনপথ লংগদু, লংগদু জীপে যাত্রা করলাম মাঝ দুপুরে। দুপুরে অলস প্রকৃতি, সর্পিল পাহাড়ে পথ পেরিয়ে সবুজ বনানীতে চললাম, দূরের পাহাড়গুলো যেন আকাশ হেলান দেয়। কালো পাহাড়ে সীমানা পেরিয়ে দুর্গম বনের গন্ধ মেখে পাহাড়ের পথে সাজেকগামী পর্যটকের দল। দুপুরের রোদ মেখে জীপের ছাদে চললাম উপত্যকার দিকে, পথে স্বল্প চা বিরতি। চায়ের উষ্ণতাও যেন পাহাড়ের গন্ধ।
খোলা আকাশের নিচে বিশাল সমৃদ্ধ বনভূমির দিকে চোখ যায়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে পাহাড়িয়া জুম চাষ, বাহারি ফসলের চাষে ভরপুর পাহাড়। উড়োবাজার, গঙ্গারামমুথ, নন্দরাম এসব পাহাড়ি-পাড়া পেরিয়ে আমাদের দ্বিতীয় যাত্রা বিরতি শেষ করে পৌছে গেলাম রুইলুই পাড়ায়।তখন প্রায় সন্ধ্যা। পূর্ণিমায় আলোকিত পাহাড়ি রাজ্য। গভীর অরণ্যের পাড়ার দুপাশে কাচালং রির্জাভ ফরেস্টের দুর্গম বনাঞ্চল। আকাশজুড়ে সহস্র নক্ষত্র। আকাশের তারা যেন আছড়ে পড়বে পাহাড়ের পৃথিবীতে। উপত্যকা ভাঁজে ভাঁজে জমবে মেঘ, সাদা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে পাহাড়। পূর্ণিমায় আলোয় আলোকিত পুরো পাড়া।
ধবধবে জোছনার আলোয় আলোকিত উপত্যকার পুরো রাজ্য। রাতের আলোয়, কাছে দূরের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জেগে উঠছে ঘন সাদা কুয়াশা। এমনই ঘন যে, কুয়াশাকে মনে হয় মেঘের ভেলা। এরকমই মেঘের ভেলায় ডুবে যাওয়া পাহাড়ের চূড়াকে মনে হচ্ছিল সমুদ্রের পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। বিভ্রম জাগে, একি আমাদের চেনা পৃথিবী!প্রয়োজনীয় তথ্য: নৌপথে রাঙামাটি, শুভলং, কাট্টলি বিল, লংগদুও বেড়ানো যাবে সাথে সাজেক ভ্রমণ। ঢাকা থেকে এসি /ননএসি বাসে রাঙামাটি পৌঁছে, রাঙামাটি থেকে দেশি বোট বা লঞ্চে করে লংগদু, লংগদু থেকে জিপে করে সাজেক পৌঁছানো যায়।
তবে সাজেকে রাত যাপনের জন্য রির্সোট বা রির্জাভ জিপ আগে থেকে ঠিক করে রাখতে হবে। রাঙামাটি, সাজেক ভ্রমণের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮১৫-৮৫৬৪৯৭ নম্বরে।