অনিন্দ্য আফরোজ
প্রবাদটি সব সমাজেই প্রচলিত-‘রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’।দুঃসময়ে কেউ ভাবলেসহীন হয়ে নিজের কাজ করতে থাকলে এমন প্রবাদ শোনা যায়। কিন্তু এই নিরোকে নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত আছে। অনেকেই নিরোকে এ ঘটনার পর অপবাদ দিয়েছিলেন তার নীরব দর্শকের ভূমিকার জন্যে।
অন্যদিকে এই অপবাদকে মিথ্যে অভিহিত করে কেউ কেউ এও দাবি করেছিলেন, নিরো ঘটনার পর পর ক্ষতিগ্রস্ত রোমবাসীর পাশে দাঁড়ান এমনকি পরবর্তীতে ধ্বংসস্তূপ রোমের ওপর নতুন ও চোখ ধাঁধাঁনো নতুন রোম নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে নিরোর ভূমিকা নিয়ে তর্ক- বিতর্ক যাই থাক কেন, প্রকৃত সত্য হলো রোম নগরে কিন্তু আগুন লেগেছিল।আসুন এবার জানা যাক ইতিহাসের এই বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত ঘটনা বিষয়ে।
রোম নগরের সেই বহুল আলোচিত ও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয় ৬৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ১৮ জুলাই। অগ্নিকাণ্ডে রোমের ১৪ জেলার মাত্র চারটি জেলা রক্ষা পায়। বাকি দশটি জেলা ধ্বংস্তূপে পরিণত হয় । ছয় দিন ধরে অব্যাহত ওই অগ্নিকাণ্ডের পরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। আগুন লাগার পর পর গুজব ছড়িয়ে যায় যে সম্রাট নিরো পেলেটাইনের চূড়ায় বসে আগুন লাগানোর নির্দেশ দেন। নিরোর আশপাশ যখন আগুনে দাউ দাউ করে গোটা নগর গ্রাস করছিল তখন তিনি বাঁশীতে ‘স্যাক অব ইলিয়াম’-এর সুর তুলছিলেন। এ অভিযোগ বাতিল করে ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বলেন, নিরো সে সময় ‘এনটিয়ামে’ ছিলেন এবং বাঁশী যে বাজাচ্ছিলেন তা কেবল গুজব। ট্যাসিটাস মতে, এই ঘটনার পর নিরো কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে লেগে পড়েন। ক্ষতিগ্রস্তদের তিনি আশ্রয় দেন তার প্রাসাদে। এরপর তিনি নতুন ‘নগর পরিকল্পনা’ তৈরি করে ধ্বংসস্তূপের ওপর আধুনিক রোম নগর প্রতিষ্ঠা করেন।
রোমবাসীর ধারণা, ধ্বংসস্তূপের জায়গায় তিনি তার অবিস্মরণীয় স্থাপত্যকর্ম ‘ডোমাস অরিয়া’ বা স্বর্ণগৃহ নির্মাণের অভিপ্রায়েই নিরো এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। এই ধারণা আরো পোক্ত হয় যখন দেখা যায় যে অগ্নিকাণ্ডের পর ধ্বংসস্তূপের ওপর নিরো তার স্থাপত্যকর্ম তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ জন্য তার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় তিনি কর বাড়ান, মন্দিরগুলো থেকে অর্থ তুলতে শুরু করেন। এমনকি অনেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতেও দ্বিধা করেননি।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আজ রোম বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থল হলেও এই শহরেই আগুন লাগানোর অজুহাতে নিষ্ঠুরভাবে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করেছিলেন সম্রাট নিরো। তিনি মূলত, তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া অভিযোগ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে আগুন লাগানোর অভিযোগ আনেন এই ক্ষুদ্র খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের ওপর। তাদের কয়েকজনকে আবার গ্রেপ্তার করে অমানসিক অত্যাচার করে বাধ্য করেন আগুন লাগানোর দায় স্বীকার করতে। এর পর শুরু হয় নিরোর নৃশংস অত্যাচার। খ্রিস্টানদের ধরে এনে হিংস্র পশুর মুখে তুলে দিয়ে হত্যা করার মত ঘটনাও ঘটিয়েছেন নিরো। সেই রোম নগরীর ঠিক মাঝখানে এখন ‘ভ্যাটিকান সিটি’।
কে এই নিরো?
সম্রাট ক্লডিয়াস নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে সন্তানরূপে দত্তক নেন নিরোকে।এপর সম্রাট ক্লডিয়াসের মৃত্যুর পর ৫৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ১৩ অক্টোবর নিরো রোমের সম্রাট হন। কথিত আছে, সম্রাট ক্লডিয়াস নিরোর মা অ্র্যাগ্রিপ্পিনা দি ইয়াঙ্গার হাতে নিহত হয়েছিলেন। নিরোকে ক্লডিয়াসের পুত্র ব্রিটানিকাসের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ নিশ্চিতকল্পে ইয়াঙ্গার এমন কাজ করেছিলেন বলে কথিত আছে।
ইতিহাস বলছে, রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট ছিলেন এই। জুলিও-ক্লডিয়ান রাজতন্ত্রের সর্বশেষ রোমান সম্রাট এই নিরো রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে অজনপ্রিয় সম্রাট ছিলেন নিরো। ক্ষমতার অপব্যবহারের যত প্রকার আছে তা তিনি করে বেশ কুখ্যাতি পেয়েছেন এই সম্রাট। হত্যা, রক্তপাত ছিল তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের হোতা নিরো নিজের মাকে হত্যা করেন।এমনকি বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন সৎ ভাই ব্রিটানিকাসকেও (ক্লডিয়াসের ছেলে)। কথিত আছে, নিরো তার প্রথম স্ত্রী অকটাভিয়াকেও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন। এভাবেই নিজেই নিজেকে ভিলেন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্ব ইতিহাসের ঘৃরণ্য শাসকদের অন্যতম সম্রাট নিরো।