জিবরানের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিল না বলে, অন্যান্য সব অভিবাসী ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ইংরেজি শেখার জন্য তাকে একটি বিশেষ ক্লাসে ভর্তি করা হল। ছোটবেলা থেকেই জিবরান খুব নিখুঁত ছবি আঁকতে পারতো। স্কুলে ভর্তির পর তার এই বিরল প্রতিভা অচিরেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নজরে আসে। স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় জিবরানের যোগাযোগ হয় তখনকার বোস্টনের এক বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ফ্রেড হল্যান্ড ডের সঙ্গে। ফ্রেড ডে জিবরানকে এতই পছন্দ করে ফেলেন যে তিনি জিবরানের মতো খুদে প্রতিভাকে লুফে নেন এবং জিবরানের মেন্টরের দায়িত্ব নেন। ফ্রেড ডে জিবরানকে বলতেন ‘ন্যাচার্যাল জিনিয়াস’। ফ্রেড ডের উৎসাহে এবং আনুকূল্যে জিবরান বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন, গল্প ইলাস্ট্রেশন এবং ছবি আঁকার কাজ পেতে থাকলেন। এভাবে ছবি আঁকা ও চিত্রশিল্পের জগতের সিংহদ্বার সহজেই খুলে গেল জিবরানের।
খলিলের সৃষ্টিশীল বোস্টন-লাইফের শুরুতেই আকষ্মিক ছেদ পড়ে যায়। কী মনে করে বিশুদ্ধ আরবি শেখার জন্য জিবরান ১৮৯৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ফিরে যান লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। গিয়ে ভর্তি হন ‘মাদরাসাতুল হিকমায়’। সেখানে আরো কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় আরবি ভাষায় একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন কিশোর জিবরান।এরপর চার বছর বৈরুতে থাকার পর ১৯০২ সালের ১০ মে আবার বোস্টনে ফিরে আসেন। কিন্তু দুর্বাগ্য তার ফিরে আসার দুই সপ্তাহ আগে জিবরানের ১৪ বছর বয়সী বোন সুলতানা যক্ষ্মা রোগে মারা যায়। পরের বছর তার ভাই পিটারও মারা যায় একই রোগে। একই বছর জিবরানের মাও মারা যান ক্যান্সারে। পরিবারের সবাইকে হারানোর পর কিশোর জিবরানের জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। তার বড় বোন মারিয়ানা সেলাইয়ের কাজ করে তাদের দুজনের সংসার চালাতেন। বৈরুত থেকে ফিরে এসে জিবরান, ফ্রেড ডের সঙ্গে পুরো উদ্যমে পুনরায় পেইন্টিংয়ের কাজ শুরু করেন। ১৯০৪ সালে ফ্রেড ডের স্টুডিওতে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় । এরপরই চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে চিত্রশিল্পী হিসেবে জিবরানের খ্যাতি। এ প্রদর্শনীতে জিবরানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় মেরি এলিজাবেথ হ্যাস্কেল নামে এক নারীর। মেরি হ্যাস্কেল ছিলেন স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। মেরির সঙ্গে অচিরেই গড়ে ওঠে জিবরানের বন্ধুত্ব। মেরির আগ্রহে এক সময় এই সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ায়, তবে প্রেম ছিল অনেকটা একতরফা। মেরি বিভিন্ন সময় জিবরানকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। কিন্তু বার বার জিবরান তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন ‘আমি বিবাহযোগ্য নই।’ তবু মেরি হ্যাস্কেল নিজের টাকায় জিবরানকে দুই বছরের জন্য প্যারিস পাঠিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী অগস্ত রোদ্যাঁর (১৮৪০-১৯১৭) সঙ্গে আর্ট শেখার জন্য।
১৯১২ সাল। ওই বছর জিবরান বোস্টন ছেড়ে নিউইয়র্ক শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৩১-এর ১০ এপ্রিল লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে নিউইয়র্কেই তাঁর জীবনাবসান হয়। জিবরানের শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার মরদেহ লেবাননের বিসারির নিভৃত পল্লিতে নিয়ে সমাহিত করা হয়। জিবরানের কথা মতো, তার এপিটাফে লেখা আছে, ‘A word I want to see written on my grave : I am alive like you, and I am standing beside you. Close your eyes and look around, you will see me in front of you.’
ওরফালেসে ১২ বছর বসবাসের পর স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আল্ মুস্তাফা যেদিন জাহাজে উঠতে যাবেন, সেদিন তার অনুসারী লাখ লাখ নগরবাসী তাকে বিদায় জানাতে দলে দলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত সাগরপারের ধর্মশালার সামনে জনমানুষের জমায়েত রূপ নেয় এক জনসমুদ্রে। বিদায় বেলায় প্রাণপুরুষকে কাছে পেয়ে নগরবাসী একে একে উত্থাপন করে রহস্যময় জীবন-জিজ্ঞাসার নানা প্রসঙ্গ। আর তিনি উদাহরণ ও গল্পের ছলে তাদেরকে বোঝান অর্থপূর্ণ মানব জীবনের বিভিন্ন দিক। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে ভালোবাসা ও ঘরসংসারের কথা। ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্ম, ছেলেমেয়ে, খাওয়া-পরার কথা। সমাজ, ন্যায়-অন্যায়, আইনকানুন, বিচার-সালিসের কথা। সৌন্দর্য, আনন্দ, জীবন-মৃত্যু, ধর্ম ও প্রভুর কথা। আলোচনা শেষে আল মুস্তাফা ধীরে ধীরে গিয়ে জাহাজে ওঠেন। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ জনতার মুখোমুখি হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে উঁচুস্বরে তিনি তার বিদায়বেলার শেষ বক্তব্য রাখতে থাকেন। জাহাজ আস্তে আস্তে সমুদ্রতীর থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আল মুস্তাফার কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে আসে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হয়ে। ততক্ষণে ওরফালেসবাসী যার যার বাড়িঘরে ফিরে গেছেন। আল মিত্রা একা দাঁড়িয়ে আছেন সাগরপারে। তিনি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন সীমাহীন জলরাশির দিকে। তারই অশ্রুবাষ্পে আবছা হয়ে যাওয়া জাহাজ ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে দিগন্তরেখার সাথে মিলিয়ে যায়! আল মিত্রা ভাবতে থাকেন আল মুস্তাফার কথা- ‘কে তিনি? কেন এলেন? কেন ফিরে গেলেন? আর কোথায়ই বা তাঁর দেশ?’
‘দি প্রফেট’ গ্রন্থে আছে ২৬টি কাব্যিক প্রবন্ধ। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯২৩ সালে, কিন্তু এটা প্রথমবারের মতো আমেরিকার কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ৬০-এর দশকে।এরপর বিশ্বজুড়ে বইটির কাটতি এতোটা বেড়ে যায় যে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ৪০টি ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। বইটি কখনোই ‘আউট অব প্রিন্ট’ হয়নি।
খলিল জিবরান একজন প্রতিভাবান ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন মানবসভ্যতাকে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার থেকে সব কিছু উজাড় দিকে। প্রতিদানে তিনি কিছুই চাননি, নেননি।
কবির খুব ইচ্ছা ছিলো, জীবিত অবস্থায় প্রিয় স্বদেশে ফেরার। কিন্তু তিনি জীবিত ফিরতে পারেননি। মৃত্যুর পরে তাঁকে দেশে আনা হয়। সেদিন বৈরুত সমুদ্র বন্দরে হাজার হাজার শোকার্ত মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁকে বরণ করে নেয়। তিনি দেশ ছাড়ার আগে বলেছিলেন, ‘Forget not that I shall come back to you’। তিনি কথা রেখেছিলেন। তিনি ফিরেছিলেন ঠিকই বীরের বেশে।