মরমী জীবনচক্রের স্যামন ফিশ

ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৮
Spread the love

অনিন্দ্য  আফরোজ
স্যামন ফিশ বা স্যামন মাছের নাম আমরা কম-বেশি সবাই জানি। অনেকেরই হয়তো এই মাছের অদ্ভূত জীবনপ্রনালী অজানা। almonidae গোত্রের এই মাছের বাস গভীর সমুদ্রে। দক্ষিণ আটলান্টিকপ্রশান্ত মহাসাগরেই মূলত এই মাছের প্রধান নিবাস। উজ্জ্বল রুপালী রংয়ের এই স্যামন মাছের জীবন বড়ই অদ্ভূত ও বিচিত্র। অনেকে এই মাছকে পবিত্র মাছ মনে করেন। এক অনন্য মরমী রূপক লুকিয়ে আছে এই মাছের জন্ম-জীবন-মৃত্যুর গহীনে।  আজ আমরা সেই মাছের জীবন প্রণালী সম্পর্কে জানব।


প্রজনন
স্যামন মাছ গ্রীষ্ম মৌসুম হল স্যামনের প্রধান প্রজনন মৌসুম। ডিম ছাড়ার জন্য ব্যথা উঠলে মা স্যামন শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে গভীর সমুদ্র থেকে প্রজননের জন্য ছুটে যায় মিঠাপানির নদী কিংবা হ্রদে। তার পিছু ছোটে পুরুষ স্যামনটিও। সমুদ্রের লবণাক্ত জল থেকে মিঠাজলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মা স্যামন তার আহার বন্ধ করে দেয়। এই মাছের বিস্ময়কর দিক হল, তাদের প্রখর ঘ্রাণশক্তি। এই শক্তির গুণে স্যামন মাছেরা প্রজননের সময় ঠিক সেই মিঠা পানিতে ফিরে আসে ঠিক যেখানে তাদের জন্ম হয়েছিল। প্রজননের সময় স্ত্রী স্যামনের সঙ্গী হয় পুরুষ স্যামন। পুরুষটি স্যামন স্ত্রীর স্যামনের প্রজননস্থলে ডিম দেওয়ার প্রয়োজনীয় বাসস্থান তৈরি করে দেয়।
মূলত নুড়ি পাথর সমৃদ্ধ জলধারায় স্ত্রী স্যামন ডিম দেয়। ডিম দেওয়ার সময় স্ত্রী স্যামনের শরীরের কথন রক্তাভ ও ডিমের রং কমলা হয়। স্ত্রী স্যামন ডিম দেওয়ার পর পুরুষ স্যামন সেসব ডিমের ওপর শুক্রাণু ছাড়তে থাকে। এরপর পুরুষ-স্ত্রী স্যামন মিলে সে সব ডিম পাহারা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর পরই স্ত্রী স্যামনটি মারা যায়। আর মা স্যামনের মৃতদেহ থেকে পাওয়া পুষ্টি পেয়ে বেড়ে ওঠা স্যামন বাচ্চাগুলো ছুটে যায় গভীর সমুদ্রে। এভাবে স্যামনের জীবনচক্র প্রকৃতিগতভাবে এক অদ্ভূত নিয়মে বাধা। 
জীবনচক্র
নদীর উদ্দেশে ফিরতি যাত্রায় বিশ্রামহীন স্যামন দৈনিক ২৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত পথ সাঁতার কাটতে সক্ষম৷ অদ্ভুত জীবন চক্রের এই স্যামন মাছকে জার্মান ভাষায় লাক্স বলা হয়। এই মাছ জন্ম নেয় নদীর মিঠা পানিতে। এরপর চলে যায় গভীর সমুদ্রের লবণজলে। সেখানে অন্তত পাঁচ বছর বসবাসের পর স্যামন পরিপূর্ণ জীবন লাভ করে। এরপর শুরু হয় স্যামনের নতুন অভিযাত্রা৷ নিজের জন্মস্থানে ফেরার এই দুর্নিবার অভিযাত্রাই হল মা স্যামনের জীবনের শেষযাত্রা। এই যাত্রার মধ্যে লুকিয়ে থাকে নতুন জন্ম এবং জন্মদানের বাসনা। এই বাসনা খুবই বেদনার হলেও স্যামনেরা যেন এই নিয়তিকেই মেনে নেয় আনন্দচিত্তে। এজন্য আহার ভুলে কয়েকশ কখনও কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আবার ফেরত আসে জন্মস্থানে। এই যাত্রাকালে তাদের পদে পদে ফাঁদ পেতে থাকে বিপদ৷ কিন্তু সবকিছু তুচ্ছ করে সে ছুটে চলে আপন নীড়ের পানে। কখনও মানুষের হাতে ধরা পড়ে মারা পড়তে হয়, কখনও নানা প্রাণীর আহারে পরিণেত হতে হয় নআছে সে বিপদও।
স্যমানের এই বিষ্ময়কর জীবনচক্র নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। প্রশ্ন এখান থেকেই শুরু। সে হল, অনেক বছর সমুদ্রে কাটানোর পর কীভাবে এরা শত কিংবা হাজার কিলোমিটার দূরের জন্মস্থানকে চিনে নেয় তারা। আর ঠিক সেখানেই ফিরে আসে?
গবেষকরা বলছেন, স্যামন মাছেরা যখন তাদের জন্মস্থানের আশপাশে আসে, তখন এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্ব এদের ঘ্রাণইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে টের পায়৷ শৈশবে নদী থেকে সাগরে প্রথমবার দেশান্তরী হ্ওয়ার যাত্রাচিহ্ন তাদের মস্তিষ্কে হয়তো বা সংরক্ষিত থাকে ৷ যৌবনের এই ফিরতি অভিযাত্রায় তাকে তারা কাজে লাগায়৷
আবার কোনও কোনও গবেষক এও বলছেন, স্যামন মাছের এক বিশেষ ধরনের স্নায়ু ইন্দ্রীয় রয়েছে যা সমুদ্রের স্রোতপ্রবাহের ধরণ অনুযায়ী সাড়া দেয় এবং কূলায় পৌঁছাতে সাহায্য করে৷ আবার কেউ কেউ এমনও ধারণা করেন, স্যামন ফিশ ভূ-পৃষ্ঠের চৌম্বক ক্ষেত্রের ভিন্নতা টের পায়। এমন সক্ষমতা কাজে লাগায় এই মাছ।


বিপন্ন স্যামন
এই বিষ্ময়কর মাছটির জীবনচক্রের মধ্যে মানবজীবনের সামঞ্জস্যতাও খুঁজে ফেরেন কেউ কেউ। তবে যত যাই হোক মাৎসকুলের এই অদ্ভূত সদস্যটির জীবন এখন অনেকটাই নানা প্রতিকূলতায় বিপন্ন। মাৎস্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্যামনের বংশবৃদ্ধির হার ক্রমেই কমছে৷ ফ্রান্সের নদীগুলোতে জন্ম নেওয়া স্যামনের গতি-প্রকৃতি ও জন্মস্ফৃতি পর্যালোচনা করে এমন তথ্য দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এজন্য মানুষের পাশাপাশি দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন৷
এছাড়া নদ-নদীতে বিদেশি প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বেড়ে যাওয়ায় স্পেনের স্যামনদের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে নদীর জলে ভিন্নতা আসায় সেখানে ফিরে আসা এবং ডিম পাড়াও বাধাগ্রস্ত হওয়ায় স্যামনের অস্বিস্ত সংকটাপন্ন করে তুলছে।
পবিত্র মাছ
হাজার হাজার বছর ধরে জলে বিচরণ করছে স্যামন মাছ। আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা এই মাছকে ‘ঈশ্বর’ বলে মানেন৷ এজন্য স্যামন মাছের জীবনচক্র অনুসরণ করে নিজেদের জীবন সাজান তাঁরা৷ এমনকি নিজেদের ‘স্যামন মানব’ বলেও পরিচয় দিতেও ভালবাসেন তাঁরা৷ প্রকৃতির অসামান্য দান, বির্য়কর জীবনচত্রের এক মরমী প্রাণী স্যামন মাছকে টিকিয়ে রাখতে এখন সোচ্চার সবাই। চলছে বিভিন্ন দেশে আন্দোলন৷ পরিবেশ সুরক্ষা করে, জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলা করে যে করেই হোক স্যামনকে টিকিয়ে রাখাই এখন প্রধান সংকল্প।

Comments are closed