আয়না২৪ প্রতিবেদন
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারত-রাশিয়া বাংলাদেশের পাশে থেকে এই জনযুদ্ধকে সহায়তা ও সমর্থন দিলেও আরেক পরাশক্তি আমেরিকা ও চীন দখলদার পাকিস্তানের পক্ষে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিল। কার্যত এই দুই দেশ (আমেরিকা,চীন) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তি ও সমর্থন ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি।
২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে ভারত বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ায়। গণহত্যার কবল থেকে সাধারণ মানুষ যাতে রক্ষা পায় সে জন্য ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সব সীমান্ত চৌকি খুলে দেয় যাতে বাংলাদেশের অসহায় মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীই প্রথম কোনো সরকার প্রধান যিনি পূর্ব পাকিস্তানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার জোর প্রতিবাদ জানান। ভারতীয় পার্লামেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যভস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবী জানায়।
ইন্দিরা গান্ধীর কুটনৈতিক তৎপরতায় বৃহৎ পরাশক্তি রাশিয়াও পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার শিকার জনগনের পক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে একটি চিঠিও লেখেন।
কিন্তু শুরু থেকেই আমেরিকা ও চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে আসছিল। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি লিখে বলেন,‘চীনের সরকার ও জনগণ সব সময় পাকিস্তান সরকার ও জনগণের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় সমর্থন জানাবে।
এক পর্যায়ে এসে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। এই স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল মুক্তিযুদ্ধে অন্য দুই পরাশক্তি সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করার কারণে। আর এতে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে- এনিয়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত রাশিয়ার সমর্থন চায়।
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট দিল্লীতে সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে একটি সামিরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির ফলে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কোনো কারণে যুদ্ধ বেধে গেলে সেক্ষেত্রে আমেরিকা ও চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে তা হলে সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। সেই চুক্তিবলেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা যুদ্ধ বিরতি বাস্তবায়ন করাতে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করলে সোভিয়েত রাশিয়াও অষ্টম নৌবহর পাঠিয়ে দেয়। ফলে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পিছু হটে যায়। এভাবে ১৯৭১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে চীন ও আমেরিকাকে যুদ্ধে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা বরাববরই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে আসছিল। সঙ্গে ছিল চীন। এই দুই বৃহৎশক্তি পাকিস্তানকে অস্ত্রসহ যাবতীয় সাহায্য-সহযোগিতা করে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা তার প্রভাব খাটায়। কোনো দেশ যাতে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা ও সমর্থন না করে এ জন্য যা যা করণীয় তার সবই করেছিল আমেরিকা।
জাতিসংঘে আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন করেছিল।এমনকি আমেরিকা মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের ভেতরে খন্দকার মোশতাক আহমদ ও পররাষ্ট্র সচিব, মাহবুবুল আলম চাষী ও একজন সেক্টর কমান্ডরকে তাদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে। আমেরিকার এ তার এজেন্টরা মুক্তিযুদ্ধ না চালিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের গোপন প্রচেষ্টা চালায়। কলকাতায় অবস্থিত আমেরিকান কনসাল এ বিষয়ে যাবতীয় কলকাঠি নাড়ছিলেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বন্দী শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডন্ট নিক্সনের সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারের মাধ্যমে এ উদ্যোগটি এগিয়ে নিতে চান।
কিসিঞ্জারের বিবরণে দেখা যায়, কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জহিরুল কাইয়ুম সেই এজেন্টদের পক্ষে কলকাতায় আমেরিকা কনস্যুলেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাবের শর্ত ছিল শেখ মুজিবকে আলোচনায় উপস্থিত থাকতে হবে এবং ৬-দফা গ্রহণ করে স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে।
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফাল্যান্ড ইয়াহিয়া খানের নিকট এই সমঝোতার প্রস্তাব দিলে ইয়াহিয়া সাথে সাথে রাজী হয়ে যান এবং ফারল্যান্ডকে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে গোপন বৈঠক করতে বলেন। মধ্য সেপ্টেম্বরে আমেরিকান কনস্যুলেট জহিরুল কাইয়ুমকে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রবাসী সরকার থেকে বৈঠক আয়োজন করতে বলেন। জহিরুল কাইয়ুম জানালেন যে, যেহেতু ভারতের এ ব্যাপারে আপত্তি আছে সে কারণে তার পক্ষে আলোচনার আয়োজন করা সম্ভব নয়।
২৮ সেপ্টেম্বর আমেরিকার কনস্যুলরের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের গোপন বৈঠক হয়। ভারতীয় গোয়েন্দরা সব সময় মোশতাকের গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল। এ জন্যে তিনি অনেক সময় শর্তের সঙ্গে আলোচনায় সোভিয়েত রাশিয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। ১৬ অক্টোবর কাজী জহিরুল কাইয়ুম ভারতের আপত্তির কারণে ভারপ্রাপ্ত পর্যায়ে আলোচনার কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দেন।
কিসিঞ্জারের গোপন তথ্য থেকে যে বিবরণ জানা যায়, তা হলো তিনি বলেছেন অক্টোবরের শেষের দিকে নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
লরেন্স লিফশুলজ তার আন ফিনিসড রেভ্যুলেশন গ্রন্থে লিখেন, মোশতাকের দলের সঙ্গে আমেরিকার কর্মকর্তাদের কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে ৮ টি গোপন বৈঠক হয়েছে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশ বিষয়ে বক্তব্য পেশ করতে যাবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে তার স্থলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের দলের নেতা নির্বাচিত করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল নিউইর্য়ক যায়। এ ষড়যন্ত্র টের না পেলে স্বাধীনতা যুদ্ধের চরম ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো।
একদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও প্রবাসী সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সারা বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছেন আর অন্যদিকে প্রবাসী সরকারের ভেতরে আমেরিকার এজেন্টরা বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। এ ষড়যন্ত্রেও কারণেই খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মতো গুরু দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাকে নিস্ক্রীয় করে রাখা হয়।
আমেরিকা চীনসহ বৃহৎ শক্তি বলয়ের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। দীর্ঘ প্রায় নয় মাস যুদ্ধ চলার পর ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় সুনিশ্চিত হয়। কেননা, এদিন বাংলাদেশে কর্মরত পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পদত্যাগ করে ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রেডক্রসের নিরপেক্ষ অঞ্চলে আশ্রয় প্রার্থনা করে। এর পর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পন করতে শুরু। অন্যদিকে অবিলম্বে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে অস্ত্রবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৃতীয়বারের মতো ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল একে নিয়াজী অস্ত্রবিরতির জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানকে অনুরোধ করেন। এই অনুরোধের জবাবে জেনারেল মানেক শ নিয়াজীকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি যেন তার নিয়ন্ত্রণাধীন সকল সদস্যসহ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টায় আত্মসমর্পন করে। ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পূর্ব, উত্তর, ও দক্ষিণ দিক থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার উপকন্ঠে সমবেত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সেনাবাহিনীর প্রধান লে: জেনারেল নিয়াজী বিমান আক্রমন স্থগিত রাখার জন্য জেনারেল অরোয়ার নিকট অনুরোধ জানান। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫.৩০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমন স্থগিত ঘোষণা করে। এদিন ২০টি সোভিয়েত রণতরী ভারত মহাসাগরে অবস্থান গ্রহণ করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান ইষ্টার্ন কমান্ডের পক্ষে লে. জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পনের দলিলে সই করেন। পূর্বাঞ্চলে ভারত ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জিওসি-ইন-চিপ লে.জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পনপত্র গ্রহণ করেন। আর এর মধ্যদিয়েই দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এই হলো আমাদের অহংকারের লাল-সবুজ পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশে ততক্ষণে স্থান করে নেয় নতুন এক স্বাধীন দেশ-বাংলাদেশ।