সাহিত্যে বৈশাখ ও নববর্ষ

এপ্রিল ১৩, ২০১৮
Spread the love

সভ্যতার ইতিহাসে মানুষকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন পটভূমিতে প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর এই সংগ্রামের বিভিন্ন কালের ইতিহাসই মানবসভ্যতার সত্যিকারের দিনপঞ্জি। এক বিশেষ কালে বিশেষ প্রয়োজনেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রণয়ন করেছিল দিনপঞ্জি, সন-তারিখ।

সভ্যতার ইতিহাসে মানুষকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন পটভূমিতে প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর এই সংগ্রামের বিভিন্ন কালের ইতিহাসই মানবসভ্যতার সত্যিকারের দিনপঞ্জি। এক বিশেষ কালে বিশেষ প্রয়োজনেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রণয়ন করেছিল দিনপঞ্জি, সন-তারিখ। আর সেই তাৎপর্য তৎকালীন সমাজ মানসের প্রতিফলিত রূপ নিয়ে মূর্ত হয়েছিল সাহিত্যে। সময়ের পরিক্রমায় বাংলা সনের মূল কাঠামো শুরু হয়েছিল হিজরি সনকে ভিত্তি করে। কালের অনন্ত প্রবাহের একটি করে নতুন দিনের উদয় হয় আর একটি দিন হারিয়ে যায়। পৃথিবী তার মেরুরেখার ওপর একবার ঘুরপাক খেলে সম্পূর্ণ হয় একটি দিন-রাত। এমনি দিন-রাতের মালা গেঁথে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ ইত্যাদি ঋতু পরিক্রমা শেষ করে ঘুরে আসে এক একটি বছর। আসে নতুন বছর— নববর্ষ। আসে বৈশাখ। 

সম্রাট আকবরের রাজত্বের চল্লিশতম বছরে ওই সালটির ১৫১৭ অব্দ চলছিল। সম্ভবত এই প্রাচীন সালটিই আমাদের বর্তমান বাংলা সনের উৎস। জ্যোতিষী গণনায় যে সম্পর্ক যুক্ত হয়েছিল তার প্রতিটি মাসের নামেই রাখা হয়েছিল এক একটি নক্ষত্রের নামে। যে নক্ষত্রে পূর্ণিমার অস্ত হয়, সে নক্ষত্রের নামানুসারেই প্রতিটি মাসের নামকরণ রাখা হয়। আর বিশাখা নক্ষত্রযুক্ত মাসের নাম হয়েছিল ‘বৈশাখ’। জীবনের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণের সঙ্গেই নববর্ষের উৎসব জড়িত নয়। বৈশাখের সংস্কৃতি আমাদের জীবন-সাহিত্য ও বাঙালি  জীবনে জড়িয়ে পড়ে ওতপ্রোতভাবে। 

বাংলার নববর্ষ বৈশাখ, গ্রীষ্মকাল প্রভৃতি তখন নিদারুণ দাবদাহে দগ্ধ হতে থাকে। কাজেই কৃষিজীবী মানুষের মনে ভয়ভীতি, উত্তপ্ত পৃথিবী নবজলধারায় স্নিগ্ধ হবে কি না, ফসল ফলবে কি না। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গাওয়া হতো সূর্যবঞ্চনার গান—

‘ওপর দুইটি বাওনের কন্যা মেল্যা দিছে শাড়ি
তারে দেখ্যা সূর্যই ঠাকুর ফেরেন বাড়ি বারি।
ওগো সূর্যাইর মা— তোমার সূর্যাই ডাঙর হইছে বিয়া করাও না।’

পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ঐতিহ্য। এটি এমন একটি ঐতিহ্য, যার বয়সের কোনো গাছ পাথর নেই। গোড়ায় কোনো সুনির্দিষ্ট বছরের সঙ্গেও এর কোনো যোগ ছিল বলে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ বছরের প্রথম দিনটি ‘নববর্ষ’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে ‘নববর্ষ’ একটি  নির্দিষ্ট উৎসবের দিন। বাঙালির ঐতিহ্যের স্মারক। বাংলা নববর্ষের সর্বজনীন অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে চিরায়ত হয়ে ধরা পড়ে বৈশাখী মেলা, পহেলা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠান। এটি ব্যবসায়ী শ্রেণীর কাছে একটি আচরণীয় রীতি। আর গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধেবেলায় লোকজ ছড়া কেটে কেটে হতো আগুন মশাল উৎসব—

‘ভালা আইয়ে বোড়া যায়,
মশা-মাছির মুখ পুড়া যায়।’  

গম্ভীরা লোকগীতি ও লোকনৃত্যের কথা উঠে আসে বাংলা সাহিত্যের পাতায়। বৈশাখে গাওয়া হতো সেই গান—

‘বলো না ভোলা, করি কি উপাই
আমার বাজে কাজে সময় নাই।
দিনের বেলা নানান হালে
কোর্ট কাচারি মুন্সীপালে
কেটে যায়রে দিন আমার…।’

বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ইতিহাসে উৎসবরূপে পালিত হতে থাকে বাংলা নববর্ষ আর রচিত হতে থাকে অসংখ্য গল্প, কবিতা, গান— এই বৈশাখ আর নববর্ষকে নিয়ে। নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক অনন্যবৈশিষ্ট্য মিলে নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির এক প্রাণের উৎসব— প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা। নববর্ষ আদিম মানবগোষ্ঠীর কাছে ছিল সিজন্যাল ফেস্টিভ্যাল এবং নববর্ষ হিসেবে ‘পয়লা বৈশাখ’ সভ্য মানুষের কৃষুৎসব বা এগ্রিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন সৃষ্টি হয়েছিল অসংখ্য গুহাচিত্র। 

বাংলা নববর্ষ এ দেশের একটা প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সংগীত, নৃত্য, আমোদ-প্রমোদ, পানাহার প্রভৃতি পৃথিবীর যেকোনো প্রাচীন ও নবীন উৎসবের একটি অতিসাধারণ অঙ্গ। 

আমাদের অধুনা নববর্ষ এ দেশের গ্রীষ্মকালীন আর্তব-উৎসব, কৃষুৎসব উদযাপনের একটি বিবর্তিত নতুন সংস্করণ। এর ঐতিহ্য প্রাচীন, কিন্তু রূপ নতুন। নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা অবারিত স্রোতে যুক্ত হয়ে এতে সৃষ্টি করেছে এক নতুন আবহ, নতুন এক সাহিত্যধারা। আর নতুন আবির্ভূত, নবজীবন জাগরিত, সুন্দর সুস্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত। আর কালবৈশাখী এর প্রতীক। সে নববর্ষের অমোঘ-সহচর, নবসৃষ্টির অগ্রদূত, সুন্দরের অগ্রপথিক ও নতুনের বিজয় কেতন। ছন্দের গীতিতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কালবৈশাখী দেখে গেয়ে উঠেন—

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর,
তোরা সব জয়ধ্বনি কর—
ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’

অজিত কুমার গুহ ‘নববর্ষের স্মৃতি’ প্রবন্ধে স্মৃতিচারণা করে লিখছেন—
‘…চৈত্রের সংক্রান্তি আসার কয়েক দিন আগে থেকেই আমাদের ঢেঁকিঘরটা মুখর হয়ে উঠতো। নববর্ষের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে নাড়ু-মোয়া, ছানার মুড়কি ও সরভাজা দিতে হবে; তারই আয়োজন চলতে থাকতো। বাড়ি থেকে অনেক দূরে শহরের এক প্রান্তে আমাদের ছিল মস্ত একটা খামারবাড়ি। সেখান থেকে বাড়ির বাইরে গোলাবাড়িতে চৈতালী ফসল উঠতো। আর আঙিনার প্রান্তে তৈরি হতো বড় বড় খড়ের গাদা। উঠানের একধারে বড় দুটো কনকচাঁপার গাছ। এই শেষ বসন্তেই তাতে ফুল ধরতো। আর এলোমেলো বাতাসে তারই গন্ধ বাড়িময় ঘুরে বেড়াতো। কোনো কোনো দিন কালবোশেখি আসত প্রলয় রূপ নিয়ে। সারাদিন রৌদ্র দাবদাহে প্রতপ্ত মাটিকে ভিজিয়ে দিত। কচি কচি আমগুলো গাছ থেকে উঠানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো আর ভেজা মাটি থেকে একটা সোঁদা গন্ধ নাকে এসে লাগতো। তারপর পুরনো বছরের জীর্ণ-ক্লান্তি রাত্রি কেটে গিয়ে নতুন বছরের সূর্যের অভ্যুদয় ঘটতো…।’

পয়লা বৈশাখ সব বাঙালিরই জন্মদিন। সময়েরও যে প্রাণ আছে, সেই প্রাণ যে মানুষের মিলনমেলায় চঞ্চল হয়ে ওঠে, সব ভেদ-বুদ্ধির আবরণ ভেঙে উষ্ণ সেই প্রাণের ছোঁয়া যে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-নির্বিশেষে সবাইকেই উদার ও বিকশিত আহ্‌বান জানায়। সে কথাটি পহেলা বৈশাখের ভোরেই ভালোভাবে অনুভব করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩০ সনের পহেলা বৈশাখে শান্তিনিকেতনে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন—

‘…নতুন যুগের বাণী এই যে,
তোমার অবলোকের আবরণ খোলো, হে মানব,
আপন উদার রূপ প্রকাশ কর।’
[রবীন্দ্র রচনাবলি, চতুর্দশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬১]

সত্যের সন্ধানে নিবেদিত বাঙালির এমন উৎসবের মাধ্যমে নিজেকে উদ্ঘাটিত করার পথপরিক্রমা খুবই দীর্ঘ। 

রাজনারায়ণ বসু তাঁর আত্মচরিতে নিজের জীবনের নববর্ষ উদ্যাপনের কথা বলেছেন এভাবে—
‘…পয়লা জানুয়ারির বদলে পয়লা বৈশাখে নববর্ষ পালনের প্রবর্তন। এ দাবি অমূলক মনে করার কোনো কারণ নেই। ছেলেবেলায় শহরাঞ্চলে আমরা হালখাতার অনুষ্ঠান পালিত হতে দেখেছি। খাওয়াদাওয়াই ছিল তাতে মুখ্য ব্যাপার। সেই সঙ্গে গানবাজনার আয়োজনও কোথাও কোথাও থাকতো। ১৯৫০ সালে ঢাকায় লেখক-শিল্পী মজলিসের উদ্যোগে কার্জন হলে এবং মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ থেকেও আমরা নববর্ষে সাহিত্য সভা করেছি পঞ্চাশের দশকে। সওগাত অফিসের স্বল্প পরিসরে আবৃত্তি, নিজেদের রচনাপাঠ ও আলোচনা ছিল তার কর্মসূচি। সেসব অনুষ্ঠানই হতো সন্ধেবেলা।’

বাঙালির লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সমন্বিত অন্তরঙ্গ পরিচয় প্রকাশিত হয় বৈশাখের মেলাকে ঘিরে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—
‘…প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী, কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ…। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্তৃত হয়— তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ। যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভারে পল্লীর হৃদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা…।’

দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘পল্লীচিত্র’ গ্রন্থে বৈশাখে গ্রামীণ মেলার যে আকর্ষণীয় বিবরণ দিয়েছেন সেই ছবি কালান্তরে আজও ম্লান হয়নি—
‘দোকান পশারীও কম আসে নাই…। দোকানদারেরা সারি সারি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থায়ী চালা তুলিয়া তাহার মধ্যে দোকান খুলিয়া বসিয়াছে। …এক এক রকম জিনিসের দোকান এক এক দিকে। কোথাও কাপড়ের দোকান, কোথাও বাসনের, কোথাও নানাবিধ মনিহারি দ্রব্যের দোকান। এত রকম সুন্দর পিতল-কাঁসার বাসন আমদানি হইয়াছে যে, দেখিলে চক্ষু জুড়ায়। কৃষ্ণনগর হইতে মাটির পুতুলের দোকান আসিয়াছে; নানা রকম সুন্দর সুন্দর পুতুল…। জুতার দোকানে চাষীর ভয়ঙ্কর ভিড়। কাপড়ের দোকানে অনেক দেখিলাম। …লোহালক্কড় হইতে ক্যাচকেচের পাটী পর্যন্ত কত জিনিসের দোকান দেখিলাম…। মিষ্টান্নের দোকানও শতাধিক। …কুমারের দোকানে মাটির হাঁড়ি-কলসি পর্বতপ্রমাণ উচ্চ হইয়া উড়িয়াছে। কাঁঠাল বিক্রেতাগণ ছোট-বড় হাজার হাজার কাঁঠাল গরুর গাড়িতে পুরিয়া বিক্রয় করিতে আনিয়াছে…..।’

এসব মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই আসে মেলায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। গাঁয়ের বধূর ঝোঁক আলতা-সিঁদুর-স্নো-পাউডার-জলেভাসা সাবান, ঘর-গেরস্থালির টুকিটাকি জিনিসের প্রতি। আকর্ষণ তার যাত্রা বা সার্কাসের প্রতিও। আর শিশু-কিশোরের টান তো মূলত খেলনার দিকেই। মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ, মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, কদমা-খাগরাই, জিলিপি-রসগোল্লা। সবই চাই। সবার ওপরে ‘তালপাতার এক বাঁশি’—
‘সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি,
এক পয়সায় কিনেছে ও
তালপাতার এক বাঁশি।’

বৈশাখ তার রুদ্ররূপ নিয়ে আবির্ভূত হলেও তার মধ্যে একটা প্রশান্ত মায়া আত্মগোপন করে থাকে, যা মানুষ দু’হাত প্রসারিত করে বিপুল বৈভবের আনন্দে জীবনের আনন্দের সঙ্গে মিশিয়ে নেয় একটি বছরের নতুন প্রত্যাশার আনন্দে।

বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানুষের গ্রামীণ জীবনের যে রূপ-রস মাধুর্যতার ছবি ফুটে উঠেছে, তা সত্যিই অতুলনীয়। এ দেশের কৃষকের আঙিনা যখন বৈশাখে নতুন শস্যের সুগন্ধে ভরে যায়, তখন তার দোলাও লাগে মনের মধ্যে। কৃষকবধূ আঁটি বেঁধে দাহন সাজিয়ে রাখে আর সারা মুখে আনন্দ ছড়িয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানে দিন-রাত। নতুন চাল দিয়ে বাড়িতে তৈরি হয় পিঠে আর ক্ষীর। নতুন অন্নকে বছরের প্রথমে বরণ করার জন্যই জীবনের এই ছোট উৎসব। কৃষক আর কৃষকবধূ অপেক্ষা করে এ দিনের জন্য। সুগন্ধি তেল দিয়ে কৃষকবধূ তার খোঁপা বাঁধে। খোঁপায় রঙিন ফিতে জড়িয়ে হাতে পরে কাচের চুড়ি। চায়ের দোকানে আড্ডা বসে— নাগরদোলায় চড়ে শিশুরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। পুতুলনাচ দেখে সবাই চমৎকৃত হয়ে হাততালি দেয়। 

জীবনের এই টুকরো আনন্দের মধ্যে ধরা পড়ে রূপ-বৈভবের চেতনামিশ্রিত নতুন অনুভবের উল্লাস। এ রূপ চিরন্তন, এ রূপ জন্ম দেয় এ দেশের সংস্কৃতির, যা মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বর্ষ শেষে চৈত্র বিদায় নেয় আকাশে কালো পুঞ্জমেঘ বিস্তার করে। সে মেঘে কখনো আকাশ আবৃত হয়ে যায় মেঘলায়; কিন্তু মানুষের জীবনে প্রত্যাশার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না।

‘বর্ষশেষ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
‘ধাও গান, প্রাণ-ভরা ঝড়ের মতন ঊর্ধ্ববেগে
অনন্ত আকাশে।
উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা
বিপুল নিশ্বাসে।
হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে—
ছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত-আঘাতে
উড়ে হোক ক্ষয়
ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত
নিষ্ফল সঞ্চয়।’

একটি বছরের নিরাশা আর বেদনাকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতে চায় বৈশাখের ঝড়ে দূরে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়। নববর্ষ মানুষকে দেয় আশা আর পরিতৃপ্তির কামনা, মন বারবার বলে ওঠে—
‘ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ
ভাঙিয়া মধ্যাহ্ন তন্দ্রা জাগি উঠে বাহির ধারে।’

বাংলা কাব্য-সাহিত্যে যোগ হলো বৈশাখী পালনের নানান গান, কবিতা ও গল্পের আখ্যান। 
আহমদ ছফা তাঁর ‘বাঙালির পহেলা বৈশাখ’ প্রবন্ধে লিখেছেন—
‘…আমরা ছোটবেলায় দেখেছি বেলা আট-নয়টা বাজার সাথে সাথে বাড়িতে আচার্য বামুন আসতেন। তিনি পাঁজি খুলে অনেকটা আবৃত্তির ঢঙে বলে যেতেন, এই বছরের রাজা কোন গ্রহ, মন্ত্রী কোন গ্রহ, এ বছরে কত বৃষ্টি হবে, কত ভাগ সাগরে আর কত ভাগ স্থলে পড়বে, পোকামাকড়, মশা-মাছির বাড় বৃদ্ধি কত। তারপর আমাদের কোষ্ঠী দেখে দেখে গণকঠাকুর বলে যেতেন। এ বছরটি কার কেমন যাবে। সমস্ত মুসলিম বাড়িতে কোষ্ঠী রাখা হতো না— সব বাড়িতে গণকঠাকুরও আসতেন না। 
…হিন্দু পরিবারগুলোতে নাড়–, মুড়ি-মুড়কি, মোয়া— এসব ভালোভাবে তৈরি করতো। মুসলমান পরিবারে এসবের বিশেষ চল ছিল না। মুসলমান বাড়ির পিঠাপুলি এসবও হিন্দু বাড়িতে তৈরি হতো না। আমাদের পরিবারের সঙ্গে যেসব হিন্দু পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল সেসব বাড়ি থেকে মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, নাড়ু এগুলোর হাঁড়ি আসতো। এ হাঁড়িগুলো ছিল চিত্রিত। আমাদের গ্রামে এগুলোকে বলা হতো ‘সিগ্যাইছা পাতিল’। আমার মা এ হাঁড়িগুলো যত্ন করে ছাদের ওপর রেখে দিতেন। আমরা সুযোগ পেলেই চুরি করে খেতাম। 
…পহেলা বৈশাখের দিন ঘরবাড়ি যথাসাধ্য পরিষ্কার করা হতো। গোয়ালঘরে বিষকাটালির ধোঁয়া দেওয়া হতো। বিষকাটালি এক ধরনের বিষাক্ত লতা। খালের পাড়ে, পুকুরের ঢালুতে অজস্র বিষকাটালি গুল্মলতা জন্মাতো। অনেক দিন আমি বিষকাটালির ধোঁয়া দেওয়ার কারণ বুঝতে পারিনি।’

সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও নানা পালাবদলের মাত্রিকতায় নববর্ষে একটি মৌলিক ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। তাহলো নবজন্ম, পুনরুজ্জীবনের ধারণা, পুরনো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি। ইংরেজ কবি টেনিসন যখন বলেন—
‘রিং আউট দি ওল্ড, রিং ইন দি নিউ
রিং, হ্যাপি বেলস, এ্যাক্রস দি স্নো:
দি ইয়ার ইজ গোয়িং, লেট হিম গো,
রিং আউট দি ফলস, রিং ইন দি টু।’

আর তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখি আরেক নান্দনিক উচ্চারণ—

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপসনিশ্বসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।

মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশ রাশি    শুষ্ক করে দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাখ
মায়ার কুজ্ঝটিকাজাল যাক দূরে যাক।’

বাংলা কাব্যে বৈশাখ নিয়ে আরও পরিচ্ছন্ন একটি কবিতা পাঠককে মুগ্ধতার দিকে টেনে নিয়ে যায়—

আজ আমরা এক অগ্নিবলয়ের প্রান্তে
এসে দাঁড়িয়েছি
বাড়িয়েছি দু’হাত উত্তাপের প্রত্যাশায়
আমরা হিমশক্তি
ক্লান্ত কুয়াশার শোষণে 
আমরা রসরিক্ত
আমাদের মেরুদণ্ডে বরফের তীব্র প্রদাহ
আমরা উত্তাপ চাই
আমরা উত্তাপ চাই।
[অগ্নিবলয়ের প্রান্তে, মযহারুল ইসলাম]

প্রাগুক্ত উচ্চারিত প্রত্যাশিত প্রত্যাশার বৈপরীত্যে বহমান বাংলা কাব্যের ধারা। বাংলা কাব্যে বৈশাখ ও নববর্ষের দীপক রাগ উঁচু সুরে বাজে না, বাজে বিলম্বত লয়ে। বাঙালির মনন ও মেজাজের সঙ্গে তাই বৈশাখের আত্মযোগ যেন এক ক্ষীণতোয়া নদীর মতো। 

প্রাচীন বাংলার পুঁথি ও পালায়, মধ্যযুগের গানে ও গাঁথায়, কবি কঙ্কন কাজী দৌলতের বারমাস্যায় বৈশাখীর যে চিত্ত উৎসার অনুরাগ বাহিত আধুনিক বাংলা কাব্যে তার উৎসরণ তত বলিষ্ঠ নয়। 
‘বাঙালির নববর্ষ’ প্রবন্ধে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত নববর্ষের কথা বলতে গিয়ে যা বলেন, সেখান থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি—
‘…পয়লা বৈশাখের ব্যবসায়ী শ্রেণীর হালখাতা উৎসব অবশ্য অতীতে অনেক দূর অবধি খুঁজে নেওয়া যাবে। 
কিন্তু সে তো মহাজনের, ব্যবসায়ীর উৎসব। সাধারণ মানুষের তাতে উৎফুল্ল হবার কোনো কারণ থাকা উচিত নয়। মহাজনের বকেয়া শোধ করার জন্য বাধ্যতামূলক এই দিনটি কী করে প্রিয় হতে পারে? সে লাল-লাল, গোলাপি-গোলাপি সিঁদুর মাখা ‘এলাহী ভরসা’ লেখা যত কার্ডই আসুক না কেন। অবশ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবসায়ী অধিকসংখ্যক ছিল বলে হিন্দুসমাজে নববর্ষের আনুষ্ঠানিক কিছু দিক থাকতেও পারে— তবে বাঙালি মুসলমান সমাজে নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা সর্বজনীন ছিল এমন ভাবার সংগত কারণ নেই…।’

বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ ও নববর্ষকে নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও বাংলা ভাষার কবিরা কম কাব্য রচনা করেননি। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বৈশাখ। অবশ্য কবির জন্মদিনটিও বৈশাখেই। ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘে’ ধ্বংসের ইঙ্গিত লক্ষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ধুলায় ধূসর বৈশাখের পিঙ্গল জটাজাল, তার ভয়াবহ রুদ্রমূর্তি প্রত্যক্ষ করি আমরা রবীন্দ্রনাথের কাব্যে। কিন্তু কালবৈশাখী ও ধ্বংসের উৎস এই বৈশাখের ধ্বংসলীলার কাছেই রবিঠাকুরের প্রার্থনা থাকে এই বলে—

‘উড়ে হোক ক্ষয়
ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত 
নিষ্ফল সঞ্চয়।’

রবীন্দ্রনাথের কাব্যে, গানে এই কল্যাণ প্রার্থনাই বারবার ঝংকৃত। 

নীলিমা ইব্রাহীম তাঁর ‘আমার শৈশবের নববর্ষ পয়লা বৈশাখ’ আত্মজৈবনিক লেখায় সে সময়কার সময়গুলো বিধৃত করেছেন অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায়—
‘আজকের মতো আমার শৈশবে পয়লা বৈশাখ নীরবে আসতো না। চৈত্র মাসের শেষের দিকে সারা দিন ঢাকের বাদ্যি শুনতাম। মা বলতেন চরকের বাজনা। কলকাতায় এই বাজনা বাজলে দিদিমা বলতেন, শিবের গাজন হচ্ছে। ঠাকুমার সঙ্গে দেশের বাড়িতে গেলে তিনি বলতেন, দোল পূজার বাজনা। এই দোল ঠাকুর ঢেঁকির মতো লম্বা একখানা তক্তা মাথায় দিয়ে আসতো। নন্দীভৃঙ্গী সঙ্গে জটলাধারী দেবাদিদেব মহাদেব। ওই তক্তার গায়ে সিঁদুর লেপা ও চুল চড়ানো। বাড়ি বাড়ি নেচে গেয়ে চাল-পয়সা সংগ্রহ করে চলে যেত এরা। শুনতাম এরা শ্মশানে পুজো দেবে; অর্থাৎ মহাদেবের সঙ্গে একটা ভূত-প্রেত সম্পর্ক ছিল। 

…রোদ পড়তে না পড়তে নানা রকম বাঁশির আওয়াজ পেতাম। আম আ‍ঁটির ভেঁপু ক’দিন আগ থেকেই পাড়ার ছেলেরা বাজাতো। এবারের মেলা থেকে কিনে এনেছে টিনের বাঁশি, তার সুরে শ্রীরাধার পাগল হবার কথা। তবে এরা বেশিক্ষণ যন্ত্রণা দিত না। সস্তার খেলনা এত ঠুনকো থাকতো যে সহজেই ভেঙে যেত।  

…মেয়েরা কিনতো মাটির হাঁড়িকুড়ি, রান্নাবাড়ি খেলার জিনিসপত্র। আর মেলাফেরত বড়দের হাতে থাকতো রকমারি ঝালর দেয়া তালপাতার পাখা। রথের মেলা থেকে যারা ফিরতেন তাদের হাতে থাকতো ইলিশ মাছ আর আনারস। কারণ সেটা হতো আষাঢ়ে আর বৈশাখে।

…সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির দোতলায় হল কামরায় গানের জলসা বসতো। বাবা ভালো গাইয়ে ছিলেন। তার ক্লাবের সংগীতপ্রিয় সঙ্গীরা আসতেন। হারু কাকা আমাদের গান শেখাতেন। খুলনায় আরেকটি বাড়িতে নিয়মিত জলসা হতো। সেটা আইনজীবী সুবোধ মজুমদারের বাড়িতে। এই গানের আসরে সুন্দর রঙিন তরমুজের শরবত সবাইকে দেয়া হতো। সঙ্গে সন্দেশ রসগোল্লা থাকতো। কিন্তু ট্রের ওপর সাজানো তরমুজের শরবতের গ্লাসগুলোর কথা ভাবলে আজও আমার জিহ্‌বা লালাসিক্ত হয়ে ওঠে।’

এসব লেখকের লেখায় বাংলার চিরায়ত রূপ ফুটে উঠেছে। যেখানে কোনো ভনিতা নেই। এ লেখাগুলোকে সে সময়কার দিনলিপি বলা যায়, দিনলিপি কখনো কি কেউ মিথ্যে লেখে!

বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘নববর্ষ উৎসব : রূপ-রূপান্তর’ প্রবন্ধে লিখেছেন—
‘বাঙালির নববর্ষ উৎসবে রূপ-রূপান্তরের যে ছোঁয়া লেগেছে, আমাদের সৃষ্টিশীল ভুবনের দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই উপলব্ধ হবে। মধ্যযুগের কবিদের রচনায় বৈশাখ এসেছে প্রধানত প্রকৃতির অনুষঙ্গে। উত্তরকালে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের কবিতা ও গানে নববর্ষ এসেছে জীর্ণ-পুরাতনকে সরিয়ে নতুনের আহ্‌বান উৎস হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ জীর্ণ-পুরাতন-গতানুগতিক জীবনকে বর্জন করে বৈশাখের আগমনে নতুন সত্ত্বা নিয়ে সকলকে জাগ্রত হবার আহ্বান জানান।’ 

সনাতন-গতানুগতিক প্রচল সমাজের পরিবর্তে নতুন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার ডাক থাকলেও রবীন্দ্রনাথের গান এখানে বিগত বছরকে ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে আহ্‌বানেই মুখর। কাজী নজরুল ইসলামের গানেও আমরা ওই একই ধারার অনুবর্তন লক্ষ করি। নজরুল লিখেছেন—

‘এলো এলোরে বৈশাখী ঝড়,
ঐ বৈশাখী ঝড় এলো এলো মহীয়ান সুন্দর।
পাংশু মলিন ভীত কাঁপে অম্বর,
চরাচর থরথর
ঘন বনকুন্তলা বসুমতী
সভয়ে করে প্রণতি,
পায়ে গিরি-নির্ঝর  
ঝর ঝর।

ধূলি-গৈরিক নিশান দোলে
ঈশান-গগন-চুম্বী
ডম্বরু ঝল্লরী ঝনঝন বাজে
এলো ছন্দ বন্ধ-হারা
এলো মরু-সঞ্চয়
বিজয়ী বীরবর।’

নজরুলের গানেও রবীন্দ্রনাথের মতো প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে পুরনোকে দূর করে নতুনের আবাহনী সুর উচ্চারিত। দীর্ঘদিন ধরে বাঙালির সৃষ্টিশীলতায় বৈশাখ এভাবেই উপস্থিত হয়েছে। কবিরা-গীতিকাররা বৈশাখকে দেখেছেন নতুনের অনন্ত উৎস হিসেবে।
উত্তরকালে নববর্ষ বা বৈশাখবিষয়ক কবিতায় কখনো ভিন্ন মাত্রার প্রকাশ ঘটেছে। সে সময় কবিদের রচনায় বৈশাখ উপনিবেশ শাসিত বাংলাদেশে উপস্থিত হয়েছে মুক্তির উৎস হয়ে। সমাজ বদলের আহ্বানই উপনিবেশ পর্বের নববর্ষ-উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দেয়। মিলিত বাঙালির সংঘচেতনায় ঔপনিবেশিক পর্বের নববর্ষ অভিষিক্ত হয় বিপ্লবের বীজমন্ত্র হয়ে, কবির কণ্ঠে তাই ঘোষিত হলো এই বাণী।

অনিল মুখার্জির ‘পহেলা বৈশাখ’ কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি—

‘পহেলা বৈশাখ আজ 
কেন এই উৎসব, কিসের উল্লাস?
আমাদের দেয়ালের পাশের বাদাম গাছটি
কঠিন শীতের লাঞ্ছনায় 
দু’দিন আগেও যাকে মনে হয়েছে নিস্তেজ, প্রাণহীন
সে আজ ঝড়ের প্রতীক্ষায়।

ঝড় তাকে দিবে উন্মাদনা, দিবে নব জীবনের আস্বাদ।
পহেলা বৈশাখ 
বিপ্লবের বিঘোষক
তাই তো উৎসব
আর্তের উল্লাস।’

বৈশাখ যুগে যুগে বাঙালির কাছে হাজির হয়েছে নতুন নতুন রূপে, বাঙালি বৈশাখকে নানা সময় নানভাবে গ্রহণ করেছে। এমনি এক সময় পর্বে, মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত দিনে, বাঙালির জীবনে নববর্ষ বা বৈশাখ এসেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শক্তির উৎস হয়ে, বাঙালি জাতির অস্তিত্বের চিরায়ত উৎস হয়ে। এ সময় তাই বৈশাখের কাছে কবি প্রত্যাশা করেন যুদ্ধের অস্ত্র, হানাদার নিধনের হাতিয়ার, কামনা করেন বৈশাখী রুদ্র-তেজ—

‘আমি জানি আমার শার্টের রক্তের দগদগে চিহ্ন
তোর পতাকার বুকের ভিতর দাউ দাউ জ্বলছে
আমি রক্তের প্রতিশাধে নেব মা-রে
রক্তের বদলে আমি রক্ত শুষে যাবো
যেন আমি এক রক্তপায়ী রাগী ঈশ্বরের 
গরগরে কণ্ঠস্বর হয়ে গেছি
ঘর নেই, বোন নেই, ভাই নেই, নেই নেই
মা-রে আমার কিছুই নেই— শুধু ক্ষুব্ধ রাইফেল
দাঁতে দাঁত চেপে খুঁজে ফেরে শত্রুর খুনি ছাউনি
লোভাতুর হাত শুধু চায় শত্রুকে হত্যার 
হত্যার, হত্যার এই বিনিদ্র রক্তাক্ত উল্লাস।
এবার নববর্ষের দেয়া তোর বৈশাখী জামা
ওদের রক্তে ভিজিয়ে তোর পায়ে এনে
দেবো মা-রে।
বৈশাখের রুদ্র জামা আমাকে পরিয়ে দে-মা।’

একাত্তরে বৈশাখী প্রেরণায় শত্রু-নিধনে বাঙালির সমুত্থিত জাগরণের কথা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে কবির ছন্দোবদ্ধ শব্দগুচ্ছে। 

কবি সমুদ্র গুপ্ত তাঁর ‘বৈশাখ : একাত্তরে’ কবিতায় লিখেছেন—

‘মেঘ ছিল কি না যুদ্ধে পড়া বাঙালি সঠিক জানে না
কেননা, সেই একাত্তরে বৈশাখ ছিল কেমন অচেনা
কোথাও কোনো গ্রাম জনপদে আগুনের ধোঁয়া দেখে
মেঘ বলে ভ্রম হতো
মেঘ দেখলে বাড়ি পোড়ার গন্ধ লাগতো নাকে।
যুদ্ধের প্রথম মাসে এসেছিল পহেলা বৈশাখ
মেঘের ডম্বরু ফেলে হাতে হাতে উঠেছিল
স্বাধীনতা যুদ্ধের বজ্রনিনাদ
যুদ্ধমুখী পা আর স্বাধীনতা দেখে ফেলা চোখ 
আমাদের জেগে ওঠার 
প্রথম সাক্ষী দিল বৈশাখী মেঘ।’

এভাবে দেখা যায়, বৈশাখ বা নববর্ষ বাঙালি কবি-শিল্পীদের কাছে যুগে যুগে যুগান্তরে নতুন নতুন ভাবের উৎস হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বাঙালির আত্মবিকাশের সঙ্গে, বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের উৎসধারায় বৈশাখ বা নববর্ষ সব সময় জড়িয়ে ছিল, জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। 
কবি নজরুলের কণ্ঠ শোনা যায় এখানেও—

‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’

নববর্ষে জাতিকে আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্‌বান করে যখন রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দেন—

‘নববর্ষে করিলাম পণ
সব স্বদেশের দীক্ষা।’

এবং এ পথ মসৃণ নয়, বিঘ্নশঙ্কুল স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন— 

‘পথে পথে রক্ষিছে 
গুপ্ত সর্প ফণা।
নিন্দা দিবে জয় শঙ্খনাদ
এই তোর রুদ্রের প্রসাদ।’

আবার যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসন্ন পদধ্বনিতে বিপন্ন পৃথিবীর মুহুর্মুহু ডাক শোনা যায়, তখন নির্মমভাবে সেই স্বরূপের উপলব্ধি সেখানে ধ্বনিত হয়েছে—

‘নববর্ষ এলো আজি 
দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে
আনেনি আশার বাণী;
দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়,
প্রতিকূল ভাগ্য আসে 
হিংস্র বিভীষিকার আকারে।
তখনি সে অকল্যাণ
যখনি তাহারে করি ভয়।
যে জীবন বহিয়াছি
পূর্ণ মূল্যে আজ থেকে কেনা,
দুর্দিনে নির্ভীক বীর্যে
শোধ করি তার শেষ দেনা।’

সিকান্দার আবু জাফর তাঁর ‘হালখাতা’ গল্পে লিখেছেন—
‘ছেলেবেলায় কিন্তু পহেলা বৈশাখের ওপরে আমার একটা বিশেষ মোহ ছিল। 
কারণটা বলি। 
স্কুল যেখানে বসতো, তার পাশেই ছিল বাজার। পহেলা বৈশাখে বাজারের দোকানে হতো ‘হালখাতা’। 
জিনিসটা বুঝতাম না। বুঝবার তেমন আগ্রহও ছিল না। তবে হালখাতা উপলক্ষে দোকানদাররা যে মিষ্টি খাওয়াত গ্রাহক-অনুগ্রাহকদের, সেটাই ছিল পয়লা বৈশাখ সম্বন্ধে আমাদের মোহ এবং হালখাতা সম্বন্ধে আমার জ্ঞানের শেষ সীমানা। 
হাড়কৃপণ সাধু ময়রা পর্যন্ত সেদিন দাম না নিয়ে দু-একটা কদমা অথবা দু-চারখানা গজা অম্লান বদনে খাইয়ে দিত। তখন এইটুকু সৌভাগ্যের জন্যেই পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা হয়নি।’

‘নববর্ষ : আমাদের জন্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে সৈয়দ আলী আহসান তুলে ধরেছেন বৈশাখের কিছু খণ্ড চিত্র—
‘…আমাদের গ্রামের বাড়িতে পহেলা বৈশাখ যখন আসতো, তখন আমরা এটা বুঝতে পারতাম আমাদের জমিদার নানীর গোমস্তা নিশিকান্ত চক্রবর্তীর সামাজিক ব্যবস্থাপনা এবং আচরণের মধ্যে। তিনি আমাদের কাচারিঘর নিজ হাতে পরিষ্কার করতেন। প্রবেশপথের চৌকাঠে পানি ছিটাতেন এবং ধূপের পাত্র হাতে নিয়ে ঘরে ধূপের ধোঁয়া দিতেন। খেরোখাতা বদলাতেন এবং সকল শ্রেণীর কর্মচারীর মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করতেন। 
আমার নানাজান জমিদার ছিলেন না, জমিদার ছিলেন আমার নানী। প্রজারা নববর্ষের দিনে বাড়ির ভেতরে যাবার অনুমতি পেত এবং উঠানে যে শীতলপাটি বিছানো থাকতো সেখানে জমিদারকে দেয়া দ্রব্যাদি রাখতেন এবং তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। অস্পষ্টভাবে এ ঘটনার স্মৃতি আমার মনে ভেসে আছে। তারা পাটির উপর রূপোর টাকা রাখতো। এগুলো রোদের আলোয় ঝলমল করতো। আমরা নিজেরা নববর্ষ পালন না করলেও নববর্ষের উৎসবটাকে গ্রহণ করতাম।’

বাংলাকাব্যের মধ্যযুগে নববর্ষ পালন বলে তেমন কিছু নেই। মধ্যযুগের কাব্যে ঋতুর বর্ণনা আছে, বারমাসি আছে। ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য় গ্রামীণ ব্যঞ্জনায় মলুয়ার বারমাসি পাওয়া যায়। সেখানকার বর্ণনায় বৈশাখকে নির্দয় গ্রীষ্মকালে বলা হয়েছে যখন মানুষের গায়ে অগ্নিপ্রবাহের মতো সূর্যের উদয় হতো।  

সেই ভয়ংকর গ্রীষ্মকালে পথ চলতে ভরসা হয় না। …তবুও কন্যা ধীরে ধীরে পথ চলে। পালকের উপর শীতলপাটি বিছানো আছে, গ্রীষ্মের দাবদাহে সারা গায়ে চন্দন মেখে সেখানে কন্যা শয়ন করে। স্বপ্নের মতো দিন কেটে যায় এবং এক, দুই, তিন করে বৈশাখ শেষ হয়।

হামিদুর রহমান তাঁর লেখা স্মৃতিকথা, জীবনবোধ ও আত্মজীবনীমূলক ১৯টি স্মৃতিচারণ নিয়ে লেখা ‘জীবনবৃত্তে’ বইতে লিখেছেন বৈশাখ নিয়ে। স্মৃতির আঁধারেই বিধৃত হয়েছে ইতিহাস। শব্দের শৈলীতে জীবনের যে জলছবি এঁকেছেন তা সময়ের দর্পণে তিনি ধরে রাখতে চেয়েছেন জীবনবোধের মনোগ্রাহী বিশ্লেষণের মাধ্যমে। আর সে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে বিগত কয়েক  দশকের  সমাজচিত্র, সোনালি শৈশবের হারানো দিন, বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য-পুঁথি সাহিত্য, চৈত্রসংক্রান্তির সংস্কৃতি ও লেখকের বাবার দিনলিপির খেরোখাতা। তাতে উঠে এসেছে মানুষের জীবনবোধ ও মনোলোকের পরিশীলিত ইতিহাস। 

কবি নির্মলেন্দু গুণ জীবনবৃত্তে বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন— ‘হামিদুর রহমানের “জীবনবৃত্তে” বন্দী হয়েছে আমাদের পেছনে ফেলে-আসা শতবর্ষের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের স্ফটিকস্বচ্ছ জলছবি।’  জীবনবৃত্তে বই থেকে কিছু কথা তুলে ধরছি—

‘বৈশাখ মাস। আকাশজুড়ে মেঘের দাপাদাপি। দিগন্ত কালো হয়ে ঝড়ের পূর্বাভাস। ভয়ে নানুর গলা জড়িয়ে বসে আছি। তারপর অঝোর ধারায় শুরু হতো বৃষ্টি। উঠানে লেবুতলার নিচে জবুথবু হয়ে জড়ো হয়ে বসে থাকা আমার মায়ের পোষা হাঁসগুলি। আর সারা উঠানজুড়ে কেচোদের হামাগুড়ি, সুযোগ বুঝে হাঁসগুলিও লুফে নিত দলাদলা কেঁচো… গপাগপ গিলে ফেলে আবার প্যাঁক প্যাঁক করে চলে যেতো পুকুরে। কাকেরা সব ভিজে বসে থাকতো তেজপাতা গাছের ডালে। গোহাল ঘরে আমাদের পাশের বাড়ির লোকেরা ভিড় জমাতো হুকোয় ধোঁয়া ছাড়তে। আমি বুবুর সাথে বসে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শুনতে শুনতে অপেক্ষা করতাম মা কখন পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, রসুন ও সরিষার তেল দিয়ে মেখে মজাদার চালভাজা খাওয়াবেন। চালভাজা খেতে খেতে কখনো কানে আঙুল দিয়ে বৃষ্টির রিমিঝিমি রিদম শুনতাম। আমার বাবার পাঠ করা “তালিবনামা” পুঁথির সুর তখন এক অন্য রকম দ্যোতনার  সৃষ্টি করতো। 

আওয়ালে আখেরে পীর এই পঞ্চ তন।
জেইদিনে বান্দাগণ মুরিদ হইলো।
নূরের অঙ্গেতে তানা গরহানা আছিলো।
মস্তষ্ক সিতারা আছিলো সেইদিন।
উত্তরে কুতুব তারা সেই তারা ছিন।
বাহু হন্তে বাজু পরে হজরত আলি।
লইক্য পুনি কলিজাতে ফাতেমা সুপালি।
দুই কর্ণ দুই নূর হাসান হুসাইন।
আওয়াল আখেরে জান এই পঞ্চ জন।

আমাদের বাড়ির চারিপাশেই খোলা-ময়দান। বর্ষাকালে চুরি-ডাকাতি করা সহজ। বাবা তখন একা, আমরা ছোট শিশু। রাতে ঘুমাবার আগে বাবা বাড়ির চারিপাশ ঘুরে দোয়া পড়ে বাড়িবন্ধ করতেন, যাতে চোর-ডাকাত আসতে না পারে। একবার তিনি আমাকে একটি চোর বন্দীর ছড়া বলেছিলেন। যেমন—

চোর-চোড়ালী গাছের পাতা।
নিরলে কামাই মাথা।।
ভাঙ্গা লাঙ্গল, পরান ঈশ।
চোরার বান্লাম চৌদিশ।।
আইবো চোরা হাস্স্যা।
মরবো চোরা কাইন্দ্যা।।
আয়রে চোরা দেইখ্যা যা;
হিন্দের মুখে বাইন্দ্যা থুইছি ন’জন চোর
চোরার মায় পুছ্ করে।
আমর চোরা কি করে।।
গুয়া খায়, পিছ্কি ফালায়।
ফালের উপর লড়-বড়ায়।।
চোরারে থাইক্যা যা।
পানি ভাত খাইয়া যা।।

বাবা তখন রাত জেগে নামাজ পড়তেন। বর্ষাকালে পাটের আঁটি হতে আঁশ ছড়াতেন। বাবাকে জাগ্রত দেখে অনেক চোর সরে যেত। এক রাতে চোরেরা পাটের ছালি টেনে নিয়ে সরে পড়ে। 
বাবা তাঁর গ্রামের একটা কিংবদন্তীর কথা বলতেন : সে বহুদিন আগের কথা, গ্রামে তখন জন-বসতি কম। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে, “ইছা-কুড়ি” “গাইঙ্গলা” মাঠের পাশে, “হাঁস-কুড়ি” বিল ও মাঠের মিলন স্থলে, শিরালী-খান বলে কথিত এক ঘটনার কথা বলতেন: 

শতাধিক বর্ষ আগের কথা, 
তখন বৈশাখ মাস। আকাশ কালো হয়ে কালবৈশাখীর ঝড়ের তাণ্ডব চলছে শিল-পাথর ঘড়-ঘড়। মানুষ পাটক্ষেতের ভিতর কাজ করছে। এই পথ ধরে এক শিরালী তার বোনকে নিয়ে চলছে ভাই-বোন আলাপ করছে, শিরালী বলছে— 
“এই ধানী মাঠটা আজ শিলাঝড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।”
পাট খেতে যারা কাজ করছে, তারা এই কথা শোনে শিরালীকে বলে: আপনাকে এই মাঠ রক্ষা করতে হবে। 
শিরালী অপারগতা প্রকাশ করে। জনতা বলে, “আপনাকে আমরা যেতে দেবো না।”
শিরালী বলে: “যদি আপনারা আমাকে রক্ষা করেন তবে আমি চেষ্টা করবো।”
জনতা বলে: “আমরা আপনাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করবো।” 
শিরালী বলে: “আমি সমস্ত-শিলা এক স্থানে এনে জমা করব। আমি বৃত্ত টেনে বসে যে জায়গায় মন্ত্রপাঠ করব সেখানে সমস্ত শিলা-পাথর বর্ষিত হবে।”
শিরালী তখন একটা লম্বা-শক্ত রশি কমরে বেঁধে বৃত্তের ভিতর বসে গেল। জনতাকে বলল: “যখন পাথর বর্ষণ শুরু হবে তখন আমার কোমরে-বাঁধা রশি ধরে টেনে বৃত্ত থেকে বের করে দিবেন। না হয় আমার মৃত্যু অবধারিত।”
বৃত্তের ভিতর বসে শিরালী যখন মন্ত্র বলছে—
জটার-উপর কঙ্কন থুইয়া,
হর-গৌরী নাচে পর্বত লইয়া।
লোহার লাঙল, লোহার মই
ওরে দেও-দানা যাইবে কই?
চণ্ডী বলে যার নাগাল পাই, 
ঘাড় ভাইঙ্গা তার রক্ত খাই। 
আমার মন্ত্র-লড়ে-চড়ে,
ঈশ্বর মহাদেবের মস্তক ছিঁড়া ভূমিতে পড়ে।
প্রচণ্ড শিলাঝড় শুরু হলো মানুষ ভীতবিহ্বল, রশি ধরে টান দিয়ে শিরালীকে বের করতে পারলো না, রশি ছিঁড়ে গেল; বড় পাথর স্তূপের নীচে পড়ে শিরালী মৃত্যুবরণ করলো। পাথর-বর্ষণে একটা গর্ত হয়ে; পানির স্রোত প্রবাহিত হলো। এটাই শিরালী খাল বলে কথিত ছিল। এখন ভরাট হয়ে সমান হয়ে গেছে। জনশ্রুতি আছে যে, বহু দিন পর্যন্ত এই মাঠ শিলাঝড়ে কোন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন আমতলা বাজারে বারনী-মেলা বসত।
আমাদের গ্রাম্যভাষায় ‘চৈত-পরব’। কৃষি যন্ত্রপাতি, লাঙল, জোয়াল, মই, বিন্দা (আঁচড়া) প্রচুর আসতো। ছেলেমেয়েদের খেলার জিনিস পুতুল, বাঁশি, খাওয়ার জন্য লাড়ু-মুড়ি-খৈয়ের মোয়া, শিরার গুড় বাতাসা, খেলনা। ডাব-তরমুজ-খিরা— বিভিন্ন ফলের সমাহার। বাবা অনেক সময় নেত্রকোনা যেতেন, ফেরার পথে আমাদের জন্য তরমুজ, খেলার বাঁশি, ঘুড়ি নিয়ে আসতেন। আজ বৈশাখ এলেই বাবার কথা মনে পড়ে।

দুঃখু কইও বন্দের লাগ পাইলে 
গো নিরলে,
আমার বন্দু রঙিচঙি
জলের উপর বানচে টঙ্গিগো
দুই হাত উড়ায়া বন্ধে
ডাকে গো নিরলে
দুঃখু কইও বন্ধের লাগ পাইলে।।
(রাখালী গান, রওশন ইজদানী)’

মূলত মধ্যযুগের কাব্যে পহেলা বৈশাখের চর্চা নেই। অনেকের মতে, বৈশাখের কর্পোরেট সংস্কৃতি আধুনিক সময়ের সৃষ্টি, উনিশ শতকে এই উৎসব নাগরিকতা পেল। রবীন্দ্রনাথ এমনভাবে বৈশাখকে বরণ করেছেন, বর্ষশেষে সমাপ্তি সংগীত গেয়েছেন যে পহেলা বৈশাখ আমাদের চিন্তা-চেতনায় আবেগের মধ্যে চিরকালের জন্য ধরা পড়েছে। 

কবি শশাঙ্ক মোহন সেন একটি বর্ষ শেষে নতুন বর্ষের আবির্ভাব সম্পর্কে লিখেছেন—

‘একটি বৎসর পরে
আজি পুনঃ নীলাম্বরে
হাসি হাসি সুধামুখ যায় গড়াইয়া
এ হাসির স্রোতে ভাসি
হাসির কণিকা রাশি
তারকা বালিকাগুলি গিয়াছে মজিয়া।’