হঠাৎ ঢুকে করে কেউ যেন বাড়িতে ঢুকতে না পারে সে জন্য বাড়ির চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করে মানুষ।বন্দীরা যাতে পালিয়ে যেতে না পরে সেজন্য চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করা হয় জেলখানায়। কিন্তু একটা দেশের অভ্যন্তরে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে সে জন্য দেশের চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ!বিষয়টি আশ্চর্য হওয়ার মতোই বিষয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও পৃথিবীতে এমন দেশও কিন্তু আছে। সে দেশটির নাম অনেকে না জানলেও চীনের মহাপ্রাচীর (গ্রেট ওয়াল অব চায়না) সম্পর্কে কে না জানে? সেই মহাপ্রাচীরের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন অনিন্দ্য আফরোজ।
পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল দেশ চীন। এই দেশেই অবস্থিত মহাপ্রাচীর। এই পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যগুলোর একটি। পৃথিবীর এই আশ্চর্য ও দীর্ঘতম প্রাচীরের দৈর্ঘ্য প্রায় দুই হাজার ৬৯৫ কিলোমিটার এবং উচ্চতা চার দশমিক ৫৭ থেকে ৯ দশমিক ২ মিটার বা প্রায় ১৫ থেকে ৩০ ফুট। আর চওড়া প্রায় ৯ দশমিক ৭৫ মিটার বা ৩২ ফুট। প্রচলিত আছে যে, চীনের এই মহাপ্রাচীরের ওপর দিয়ে একসঙ্গে ১২ জোড়া ঘোড়া চলতে পারত।
আরো পড়ুন…মিশরের সাড়ে চার হাজার বছরের রহস্যময় সমাধিক্ষেত্র থেকে এ কি আবিষ্কৃত হল?
প্রাচীরের ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতক পর্যন্ত সময়ে চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য এই প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। ইট আর পাথর দিয়ে তৈরি ২২১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে শুরু হওয়া এই কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল ১৫ বছর। এ সময় প্রায় একইরকম অনেকগুলো প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল, তবে খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ২০০ থেকে ২২০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে চীনের প্রথম সম্রাট ছিলেন কিন শি হুয়াঙ।তাঁর অধীনে নির্মিত প্রাচীরটিই বিখ্যাত। এটা বর্তমান প্রাচীরের একেবারে উত্তরদিকে অবস্থিত এবং এর খুব সামান্যই এখন অবশিষ্ট আছে। আর বর্তমান যে প্রাচীরটি রয়েছে সেটি মিং রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল।
চীনে সভ্যতার শুরু হয়েছিল বহু আগে। সেই সভ্যতা চীন সভ্যতা বা চৈনিক সভ্যতা নামে পরিচিত। ওই সময় চীনের উত্তর প্রান্তে ছোট বড় বেশ কয়েকটি রাজ্য ছিল। গোবি মরুভূমির পূর্বে দুর্ধর্ষ মঙ্গলিয় যাযাবর জাতির বসবাস ছিল। এই যাযাবরেরা ছিল জাত লুটেরা। সীমানা পেরিয়ে প্রায়ই হামলা চালাত রাজ্যগুলোর ওপর। লুন্ঠন করে নিত ক্ষেতের ফসল, গবাদি পশু এবং মূল্যবান মালামাল। মাঝেমধ্যে গ্রামবাসীদেরও ধরে নিয়ে যেত এই লুটেরা সম্প্রদায়। তাদের দমন করাও ছিল রাজ্য শাসকদের জন্য মুশকিল আবার দুর্ধর্ষ যোদ্ধাও ছিল তারা। যাযাবর এই লুটেরাদের কবল থেকে রাজ্য ও রাজ্যের মানুষকে বাঁচাতেই মূলত শুরু হলয় সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের কাজ ও দুর্গ স্থাপন। এই মহাপ্রাচীরকে কল্পনা করা হয় বিশাল ড্রাগনের সঙ্গে। পূর্বে শাংহাইকুয়ান থেকে পশ্চিমে টপলেক পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। শুরু আর শেষের দিকে মহাপ্রাচীরকে দেওয়া হয়েছে ড্রাগনের মাথা আর লেজের আকৃতি। ড্রাগনের লেজ গিয়ে পতিত হয়েছে সমুদ্রে। বাদালিংয়ে মহাপ্রাচীরের ওপরে উঠলে দেখা যায়, চারদিকে সারি সারি পাহাড়। তার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে প্রাচীর।
এই প্রাচীর চীনের প্রাকৃতিক বাঁধাগুলো ছাড়া অন্যান্য অঞ্চল পাহারা দেওয়ার কাজে এবং উত্তর চীনের উপজাতি সুইং নু’র বিরুদ্ধে প্রথম স্তরের সুক্ষো ব্যবস্থা ছিল এটা। ইতিহাসে হান, সুই, নরদান এবং জিং সাম্রাজ্যের সময়ের যে কারণে তারা এটি তৈরি করেছিলেন ঠিক একই কারণে চীনের প্রাচীরের পরিবর্ধন, পরিবর্তন, সম্প্রসারণ, পুনঃনির্মাণের উল্লেখ আছে। বেইজিংয়ের উত্তরে এবং পর্যটন কেন্দ্রের কিছু অংশ সংরক্ষণ এমনকি পুনঃনির্মাণ করা হলেও প্রাচীরের বেশ কিছু অংশ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো গ্রাম্য খেলার মাঠ, বাড়ি ও রাস্তা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পাথরের উৎস হিসেবে ব্যবহূত হয়। কিছু অংশ নাশকতার জন্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার পুনঃনির্মাণের জন্য কিছু অংশ ধ্বংস করা হয়েছে।
উন্নত পর্যটন এলাকার কাছে মেরামতকৃত অংশ পর্যটন পণ্যের বিক্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। প্রাচীরটির নিয়মিত বিরতিতে পর্যবেক্ষণ চৌকি রয়েছে, যা অস্ত্র সংরক্ষণ, সেনাবাহিনীর আবাসন এবং সংকেত প্রদানে কাজে লাগত। সেনাঘাঁটি এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রসমূহ দীর্ঘ বিরতিতে অবস্থিত। গ্রেট ওয়ালের সীমানার মধ্যে সেনা ইউনিটগুলোর যোগাযোগ যেমন—দলকে শক্তিশালী করা এবং শত্রুদের আন্দোলন সম্পর্কে সাবধান থাকা ছিল উল্লেখযোগ্য। দেখার সুবিধার জন্য পাহাড়সহ অন্যান্য উঁচুস্থানে সংকেত টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছিল।
এটা শুধুই প্রাচীর?
মহাপ্রাচীরটি একটা অবিচ্ছিন্ন লম্বা দেয়ালএটা সত্য। তাই বলে এটা কি শুধুই প্রাচীর? না এটা কেবলই প্রাচীর নয়। কেননা প্বিরাচীরটিতে রয়েছে ভিন্ন টাওয়ার, যেখানে সেনারা পাহারায় থাকতো এবং আছে সেনাদের আবাসস্থল। ধারণা করা হয়, মিং সাম্রাজ্যের সময় প্রায় ১০ লাখ সেনা এই প্রাচীরটি পাহারায় নিয়োজিত থাকতো। এটি ছিলো তাদের সামরিক প্রতিরক্ষার দূর্গ।
পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিষ্ময় চীনের এই মহাপ্রাচীর।এজন্য দেশ-বিদেশের অগণিত পর্যটক প্রতিদিন এখানে আসেন এই আশ্চর্য প্রাচীর দেখতে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এই সময়ে পর্যটকদের বেশি ভিড় থাকে । তবে শীতে যখন তুষার পড়ে, তখন প্রাচীর আরসারি সারি পাহাড় তুষারে ঢাকা পড়ে। তখন অন্যরকম এক সৌন্দর্যের অবতারণা হয় এখানে। তুষারে আচ্ছাদিত শীতের মহাপ্রাচীর যেন আরো দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। সারা বছরই প্রাচীরের ওপর তীব্র বাতাস বয়। শরৎ আর শীতকালে তো কথাই নেই। তখন আশ্চর্য সৌন্দর্য, আর উঁচু ও সুদীর্ঘ মহাপ্রাচীরের রোমাঞ্চকর হাতছানি আরো বেশি মুগ্ধকর।