বিশেষ প্রতিনিধি
টাইটানিক জাহাজ নিয়ে এখনো সারা পৃথিবীর মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। শুধু সাধারণ মানুষ কেন, সমুদ্র অনুসন্ধানকারী গবেষকদেরও এনিয়ে বেশ আগ্রহ রয়েছে। ১০৭ বছর আগে সেই জাহাজটি ডুবে যাওয়ার পর সমুদ্রতলে এখন কেমন আছে-সেটা নিয়েই এই কৌতূহল। এই কৌতূহল থেকেই সম্প্রতি সমুদ্রতলে তা দেখতে ডুব গিয়েছিলেন একদল ডুবুরি। এবারই প্রথম ডুবুরিরা টাইটানিক দেখতে সমুদ্রতলে গিয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। তবে গেল ১৪ বছর পর ডুবুরিদের টাইটানিক দেখতে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
সমুদ্রতলে গিয়ে এবার ডুবুরিরা দেখেছেন ধীরে ধীরে সমুদ্রতলের মাটির নিচে পুঁতে যাচ্ছে টাইটানিক। সেইসঙ্গে ধাতব পদার্থখেকো ব্যাকটেরিয়া টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের বাকিটুকুও খেয়ে ফেলছে।
সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সমুদ্রে অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান ‘টাইটন সাবমেরিন্সের’ ডুবুরিরা চলতি মাসেই পাঁচ দফায় টাইটানিকের বর্তমান অবস্থান দেখতে যান।
অনুসন্ধান করে তাঁরা দেখতে পান, জাহাজটির অবস্থান এখন উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের চার হাজার মিটার গভীরে এবং কানাডার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত নিউফাউন্ডল্যান্ড অ্যান্ড ল্যাব্রাডোর প্রদেশ থেকে ৩৭০ মাইল দক্ষিণে। বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী এবং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেন অ্যান্ড এটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রতিনিধি দল এই অভিযানে অংশ নেয়।
অভিযাত্রীক দলটির সদস্যরা, ডুবে যাওয়া টাইটানিকের চার হাজার ভিডিও ফুটেজও নিয়েছেন। এসব ফুটেজ এখন বিভিন্নভাবে বিশ্নেষণ করছেন তাঁরা। এ ছাড়া ‘আটলান্টিক প্রডাকশন’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ডুবে যাওয়া টাইটানিক নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। এসব ফুটেজ সেই তথ্যচিত্রে তাঁরা ব্যবহার করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাবমেরিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘টাইটন সাবমেরিন্সের’ প্রধান প্যাট্রিক লাহে বলেন, চিত্তাকর্ষক বিষয় হচ্ছে, আমরা এবার দেখতে পেয়েছি কীভাবে টাইটানিক সমুদ্রতলের আরও গভীরে চলে যাচ্ছে। ধাতব পদার্থ খেকো ব্যাকটেরিয়া কীভাবে টাইটানিক খেয়ে ফেলছে তাও আমরা দেখতে পেয়েছি।
১৯১২ সালে বিশাল বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায় তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় জাহাজ টাইটানিক।আরএমএস টাইটানিক একটি ব্রিটিস যাত্রীবাহী বৃহদাকার সামুদ্রিক জাহাজ ছিল যা ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল জাহাজটির প্রথম সমুদ্রযাত্রায় সাউথহ্যাম্পটন থেকে নিউইর্য়ক সিটি যাওয়ার পথে ডুবে যায় । ‘টাইটান’ ছিল গ্রিক পুরানের শক্তিশালী দেবতা। তার নামানুসারে এই জাহাজের নাম রাখা হয়েছিল ‘টাইটানিক’। এটি আসলে জাহাজটির সংক্ষিপ্ত নাম। এর পুরো নাম ছিল ‘আর এম এস টাইটানিক’। ‘আর এম এস’ এর অর্থ হচ্ছে ‘রয়্যাল মেল স্টিমার’। অর্থাৎ পুরো জাহাজটির নাম ছিল ‘রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক’।টাইটানিক জাহাজটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয় ১৯০৭ সালে। পাঁচ বছর একটানা কাজ করে ১৯১২ সালে জাহাজটির কাজ শেষ হয়। হল্যান্ডের ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ এই জাহাজটি নির্মাণ করেন। ৬০ হাজার টন ওজন এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাহাজটি নির্মাণ করতে সে সময় খরচ হয়েছিল ৭৫ লাখ ডলার।
টাইটানিক যখন দুর্ঘটনা স্থলের প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। তখনই জাহাজের ক্যাপ্টেন সামনে আইসবার্গ এর সংকেত পান। আইসবার্গ হল সাগরের বুকে ভাসতে থাকা বিশাল বিশাল সব বরফখণ্ড। এগুলোর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এগুলোর মাত্রই আট ভাগের এক ভাগ পানির উপরে থাকে। মানে, এর বড়ো অংশটাই দেখা যায় না। তখন তিনি জাহাজের গতি সামান্য দক্ষিণ দিকে ফিরিয়ে নেন। সে সময় টাইটানিকের পথ পর্যবেক্ষন কারীরা সরাসরি টাইটানিকের সামনে সেই আইসবার্গটি দেখতে পায় কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। টাইটানিকের ফার্স্ট অফিসার মুর্ডক আকস্মিকভাবে বামে মোড় নেওয়ার অর্ডার দেন এবং জাহাজটিকে সম্পূর্ণ উল্টাদিকে চালনা করতে বা বন্ধ করে দিতে বলেন। টাইটানিককে আর বাঁচানো সম্ভব হয় নি। এর ডানদিক আইসবার্গের সাথে প্রচন্ড ঘষা খেয়ে চলতে থাকে। ফলে টাইটানিকের প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয়। টাইটানিক জাহাজটি যেই স্থানে ডুবেছিল সেই স্থানের নাম হলো ‘গ্রেট ব্যাংকস অফ নিউফাউন্ডল্যান্ড’। টাইটানিক সর্বোচ্চ চারটি পানিপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট নিয়ে ভেসে থাকতে পারতো। কিন্তু জলপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ৫টি কম্পার্টমেন্ট। এছাড়া পানি প্রতিরোধ এর জন্য ১২টি গেট ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এমন জায়গায় জাহাজটির ধাক্কা লাগে যে, সবগুলো গেটের জল প্রতিরোধ বিকল হয়ে যায়। জল ভারে আস্তে আস্তে পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে টাইটানিক।
দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৫ সালে যন্ত্রচালিত অনুসন্ধান শুরু করে একদল বিজ্ঞানী। রবার্ট বালার্ড নামক ফরাসি বিজ্ঞানী টাইটানিককে খুঁজে বের করন। ১৯৮৫ সালে এর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আনসিংকেবল টাইটানিক এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৬০০ ফুট নিচে আটলান্টিকের তলদেশে স্থির হয়ে আছে। দ্বিখণ্ডিত জাহাজটির দুটো টুকরো ১৯৭০ ফুট দূরে অবস্থান করছে। টাইটানিকের সম্মুখভাগ সমুদ্রতলে ৬০ ফুট মাটির গভীরে প্রোথিত। ১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই ঘটনার ৭৪ বছর পর টাইটানিক পুনরাবিষ্কৃত হয়।
১০৭ বছর ধরে টাইটানিক আটলান্টিকের তলদেশে রয়েছে। কিন্তু সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আজও টাইটানিক েএক ভিন্ন মাত্রার কৌতূহল হয়েই রয়েছে।