রাসপুতিন নামটি আমাদের কমবেশি সবার জানা। রহস্যময় এই ব্যক্তিকে নিয়ে এখনো মানুষের মধ্যে জানার আগ্রহ ফুরায়নি। কথিত আধ্যাত্মিক পুরুষ রাসপুতিনকে নিয়ে যেমন রয়েছে নানাবিধ রহস্য তেমনি রাজতন্ত্রের নিয়ামক এই ব্যক্তি ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবেও সমধিক পরিচিত। ঐতিহাসিকদের মতে, তার ছিল আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তিনি সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন কুটিল এবং নিজ স্বার্থে। ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতাও নাকি ছিল রহস্য পুরুষের। রাশিয়ার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। যা ছিল তার মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত।
তার এই আধ্যত্মিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তিনি রাশিয়ার নিন্দিত জার শাসকের রাজদরবারে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কথিত আছে এই রহস্যগুরু সারাক্ষণ নারীদের নিয়েই মশগুল থাকতেন। রুশ জারতন্ত্রের উপদেষ্টা রাসপুতিন সম্পর্কে জানাচ্ছেন অনিন্দ্য আফরোজ-
মানব সভ্যতার ইতিহাস কেবল সেই ব্যক্তিদেরই মনে রাখে যারা নিজেদের আলো ছড়িয়ে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন, এগিয়ে নিয়েছেন। পাশাপাশি সেই সব ব্যক্তিদেরও মনে রাখে যাদের কুকীর্তি পৃথিবী কিংবা মানবতাকে লুণ্ঠিত করে। আলোর পথে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও যেমন পৃথিবীতে কম নয় তেমনি অন্ধকারের পথে হেঁটেছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা নেহায়েত পৃথিবীতে কম নয়। রাসপুতিন এমনই এক রহস্য মানব যিনি তার কুকীর্তির জন্য ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি, ভস্যিৎ গণনাসহ নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারি এই ব্যক্তি রাশিয়ার শেষ জার নিকোলাসের উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছিলেন। কথিত আছে ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে তিনি ব্যাপক পড়াশোনা করতেন। এতে রহস্যময় চরিত্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। নারী এবং মদের প্রতি প্রবল আসক্তি ছিল তার। দুর্বল, মেরুদণ্ডহীন রুশ জার নিকোলাসের স্ত্রীর সঙ্গে প্রণয় ছিল তার। জারের স্ত্রীকে কুমন্ত্রনা দিতেন রাসপুতিন। জারের স্ত্রীও রাসপুতিনের কথামতো কাজ করতেন। এতে রুশ রাজতন্ত্রে সহজেই নিজের প্রভাবশালী অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হন রাসপুতিন। এর প্রভাব পড়েছিল সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায়ও।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ধারণা, রাসপুতিন হিপনোটাইজিংয়েরবিদ্যা ছিল। মূলত, জারতন্ত্রে একচ্ছত্র হস্তক্ষেপ, প্রভাব বিস্তার এবং তার উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, নারীদের প্রতি অশালীন আচরণসহ নান কারণে রাসপুতিনের অনেক শত্রু তৈরি হয়েছিল।রাসপুতিনের প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ বিষ পান করতেন। আর ধীরে ধীরে এই মাত্রা বাড়াতে থাকেন। এভাবে বিষের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান তিনি।রহস্যময় জীবন-যাপনে অভ্যস্ত রাসপুতিন হয়তো আগেই আশংকা করেছিলেন তাকে বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যার চেষ্টা হবে। কারণ সবার ধারণা ছিল রাসপুতিন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন। পরবর্তীতে সাতজন মানুষকে যে পরিমাণ বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলা সম্ভব সেই পরিমাণ মেশানো খাবার সরবরাহ করেছিল তার শত্রুদের একটি দল। এরা ছিলেন রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণির, যারা জার শাসনের বিরোধী ছিলেন। জারতন্ত্রের অন্যায় আচরণ, প্রজানিগ্রহী নানা সিদ্ধান্ত ওকালা-কানুনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের নেশায় মত্ত ছিলেন ওই শ্রেণি।ওই বিষ রাসপুতিনের শরীরে প্রয়োগ করার পরেও তাকে হত্যা করা যায়নি। তিনি বেঁচে যান। এসময় তাকে মৃত ভেবে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তিকে মারতে উদ্যত হলে পরে রাসপুতিনের মাথায় গুলি করা হয়। মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাসপুতিন। এরপর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বরফ জমাট নদীর বরফ ভেঙে পানিতে ফেলে দেওয়া হলেও পানিতে ডুবে নয় তীব্র ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যু হয় ইতিহাসের এই রহস্যময় খলনায়কের।
আরও পড়ুন- রাশিয়ার জারতন্ত্র ও ঐতিহাসিক সম্রাটগণ
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
তিনি রাসপুতিন নামেই পরিচিত। কিন্তু তার পুরো নাম গ্রেগরি ইয়েফেমোভিচ রাসপুতিন। রাসপুতিন একজন রুশ সন্ন্যাসী ছিলেন। পরে তিনি তার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাবলে জার দ্বিতীয় নিকোলাসের দরবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তুরা নদীর তীরে পক্রভস্কায়া নামে সাইবেরিয়ার এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম রাসপুতিনের। তিনি কবে কত তারিক জন্ম নেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ জানা যায়নি। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৩-এর মাঝামাঝি সময়ে জন্ম নেন তিনি। রাসপুতিনরা তিন ভাই-বোন ছিলেন। তার বড় ভাই দামিত্রি এবং বোন মারিয়া। ছোটবেলা থেকেই রাসপুতিন ছিলেন ভবঘুরে চরিত্রের।
সন্ন্যাস
সন্ন্যাসী রাসপুতিনের উত্থানের শুরুটা হয়েছিল সাধারণ চাষি পরিবার থেকে। ছোট্ট গ্রামে তার বেড়ে ওঠা। তার বাবা ঘোড়া পালন করতেন। রাসপুতিন যখন বালক তখন তাদের বেশ কয়েকটি ঘোড়া চুরি হয়। কথিত আছে, ওই সময় রাসপুতিন ঘোড়া চোরের নাম বলে দিয়েছিলেন। পরে তার কথা অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে জানা গেল রাসপুতিনের কথাই ঠিক। এই ঘটনা রটে যায় সারা গ্রামে। চাউর হয়, রাসপুতিনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। গ্রামের লোকজন বলাবলি করতে থাকে খ্রিস্টের আশীর্বাদ আছে রাসপুতিনের। ১৮ বছর বয়সে রাসপুতিনের মধ্যে ধর্মীয় নানা পরিবর্তন শুরু দেখা দেয় । ওই সময় তিনি তিন মাস ভার্কোটারি মনাস্ট্রিতে কাটান। এরপর যখন নিজ শহরে ফিরেন, তখন তিনি এক পরিবর্তিত মানুষ হয়ে যান। ধারণা করা হয়, মনাস্ট্রিতেই তিনি আধ্যাতিক শক্তির চর্চা করেছিলেন। এরপর তিনি বিয়ে করেছিলেন প্রসকোভিয়া ফিয়োদরোভনা নামে এক নারীকে। এই দম্পতির তিন সন্তানও ছিল। তবে সংসারে থিতু হতে পারেননি রাস। স্ত্রী-সন্তান ফেলে এখানে ওখানে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ান। এ সময় তিনি গ্রিস ও জেরুজালেমও সফর করেন। মাঝে মধ্যে নিজ শহর পকরভস্কয়িতে ফিরে আসতেন। আবার চলে যেতেন। বলা হয়ে থাকে এই সময়ে আধ্যাত্মিক সাধনা করেন। ১৯০৩ সালে চলে যান সেন্ট পিটার্সবার্গে। ওই সময় তিনি নিজেকে পবিত্র আধ্যাত্মিক গুরুজন ঘোষণা করেন। ঘোষণা করেন, তার রোগমুক্তি, ভবিষ্যদ্বাণী করাসহ নানা আধ্যাতিক ক্ষমতা রয়েছে। এর আগে তার বড় ভাই দামিত্রি ও ছোট এক বোন মারিয়া দুজনই মারা যান। বোন মারিয়া ছিলেন মৃগী রোগে আক্রান্ত তাই তিনি নদীতে ডুবে মারা যান। বড় ভাই পুকুরে ডুবে পরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ভাই-বোনের অকাল মৃত্যু রাসপুতিনের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
রাজদরবারে রাসপুতিন
রুশ সম্রাট জার দ্বিতীয় নিকোলাস ও সম্রাজ্ঞী জারিনা আলেক্সান্দ্রা দম্পতির কোনো চেলে ছিল না। বহু বছর নানা চেষ্টা করেও পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হন। পর পর চার কন্যার জন্ম তাদের উত্তরাধিকারের জন্য পুত্রসন্তান লাভের জন্য উদগ্রীব করে তুলেছিল। এ জন্য তারা সবকিছু করতে রাজি ছিলেন। এজন্য তারা অনেক সন্ন্যাসীরও শরণাপন্ন হন। এসব চেষ্টার পর জারিনা আলেক্সান্দ্রা ১৯০৪ সালে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখা হয় আলেক্সি নিকোলায়েভিচ। নিকোলাস ও জারিনা এবার উত্তরাধিকারের ভাবনা থেকে মুক্ত হলেও দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি। তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত এই পুত্র আক্রান্ত হলো হেমোপিলিয়া রোগে। পুত্র আলেক্সির রক্তক্ষরণ শুরুহলে, তা আর বন্ধ হতো না। কথিত আছে,নিকোলাসের ভুলের কারণেই এমন বিপদ তৈরি হয়েছিল। কারণ অ্যালেক্সজান্দ্রাকে বিয়ের পর এবং নতুন জার হিসেবে অভিষেকের সময় নিকোলাস তার প্রজাদের জন্য রাজকীয় ভোজের আয়োজন করেছিলেন। এ জন্য খাবার ও মদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। রুশ জনগণ জারের অভিষেকের প্রাক্কালে এমন ট্র্যাজেডিকে অশুভ লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
সন্তানের আরোগ্যের আশায় সম্রাট নিকোলাস ও আলেক্সান্দ্রা ছোটাছুটি করতে থাকেন। ছুটতে থাকেন হাকিম-কবিরাজ, ফকির-দরবেশ, যাজক-ভিক্ষু আর সন্ন্যাসীদের কাছে। ১৯০৮ সালের আগে কিছুতেই কিছু হলো না।শেষমেষ ডাকা হলো গ্রেগরি রাসপুতিনকে। শেষ পর্যন্ত রাসপুতিন জারপুত্র আলেক্সিকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সূত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন জার পরিবারে। রাজ্যের বড় বড় চিকিৎকেরা যখন ব্যর্থ জার পুত্রের চিকিৎসায় ব্যর্থ হচ্ছিলেন তখন রাসপুতিনের এমন সাফল্য তার আধ্যাতিক ক্ষমতার প্রচার বাড়িয়ে দেয়। রাজ পরিবারের নানা ঘটনা-অঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বলা হয়, জোঁক দিয়ে নাকি রাসপুতিন আলেক্সির রক্ত শুষে নিয়েছিলেন। জোঁকের লালায় হিরুদিন নামে এক ধরনের রক্ত নিবারক উপাদান থাকে। যা রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। আবার অনেকে বলেন, অ্যাসপিরিন দিয়ে আলেক্সিকে সারিয়ে তুলেছিল রাসপুতিন। ১৮৯৮ সাল থেকে অ্যাসপিরিন নামক জিনিসটা ইউরোপে পাওয়া যেত। আবার কেউ বলেন রাসপুতিন এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন হিপনোটিজম। কেউ এই মতকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, রাসপুতিন হিপনোটিজম পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। রাজপরিবারের উত্তরাধিকার আলেক্সি সেরে ওঠার পর জার নিকোলাস রাসপুতিনকে রাশিয়া ও জার-পরিবারের উপদেষ্টা ঘোষণা করেন। আর এভাবেই রুশ রাজ পরিবারে প্রবেশ করেন রহস্য পুরুষ রাসপুতিন।
যৌনপিয়াসী ও মদ্যপ
রাসপুতিন ছিলেন প্রবল মদ ও যৌনপিয়াসী। কথিত আছে, যখন রাসপুতিন মদ পান করতেন তখন তার কোনো হুশ থাকত না। আবার যৌনকার্যেও ছিলেন সমানতালে বিশৃংখখল। দুইক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন মাত্রাজ্ঞানহীন। এজন্য লোকজনের কাছে তিনি ছিলেন নোংরা এক ব্যক্তি। তিনি নারীদের রাজনৈতিক আনুকূল্যের বদলে যৌন সম্ভোগ করতেন। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার বদৌলতে শিষ্যও জুটেছিল তার। শিষ্যদের সঙ্গেও তার যৌনতার নানা কাহিনী প্রচলিত ছিল। আধ্যাত্মিকগুরু প্রচারের সময় সেন্ট পিটার্সবার্গে বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ শিষ্য জুটিয়েছিলেন তিনি।এজন্য ১৯০৫ সালে তিনি রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সেন্ট পিটার্সবার্গ পৌঁছান তিনি। সেন্ট পিটার্সবার্গের অভিজাত ভক্ত-শিষ্যরাই অভিজাত মানুষের নানা সমস্যা নিয়ে রাসপুতিনের দ্বারস্থ হতেন। রাসপুতিন তার আধ্যাতিক ক্ষমতার জোরে সে সব সমস্যার সমাধান দিতেন। এই থেকেই সেন্ট পিটার্সবার্গে অভিজাত পরিবারের নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা শুরু হয় রাসপুতিনের। সন্মোহন শক্তির কারনে নারীরাই মুগ্ধ ছিল তার প্রতি। আবার তিনিও নারীদের মুগ্ধ করতে কৌশল ব্যবহার করতেন। রাজপরিবারের উপদেষ্টা হওয়ার পর থেকে সম্রাটপত্নী জারিনা আলেক্সান্দ্রার ওপর রাসপুতিনের প্রভাবও বাড়ে। রাসপুতিনের কথা ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর বলে ভ্রম করতে লাগলেন জারিনা। যদিও রুশরা বিশ্বাস করতে চায় না যে, রাসপুতিন ও জারিনা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন । যদিও সে সময় এরকমই অভিযোগ উঠেছিল। রাসপুতিনের সম্মোহনী ক্ষমতার কারণেই বহু নারী আকৃষ্ট হতেন। এতে থেকে বাদ যায়নি সামরিক কর্মকর্তাদের স্ত্রীিএমনকি রাজকর্মকর্তাদের স্ত্রীরাও। অন্য নারীরা তো ছিলই।
ভবিষ্যদ্বাণী
রাসপুতিনের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা ছিল এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করতেন। নিজের মৃত্যুর বিষয়েও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন রাস। মৃত্যুর আগে ন জার নিকোলাসের কাছে এক অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন রাসপুতিন। তিনি বলেছিলেন, “যদি আমি সাধারণ জনগনের হাতে মারা যাই, তুমি, রাশিয়ার জার, তোমার সন্তানদের জন্য কোনো চিন্তা কর না, তারা আরও শত শত বছর রাশিয়া শাসন করবে। আর যদি আমার মৃত্যুর কারণ হয় তোমার আত্মীয়দের মধ্যে কেউ, তাহলে শুনে রাখ, তোমার পরিবারের সবাই আগামী দুই বছরের মধ্যে খুন হবে, খুন হবে রাশিয়ার জনগণের হাতে।”
রোমানভ পরিবারের সদস্যের হাতে রাসপুতিনের খুন হওয়ার তিন মাস পর ঠিকই সেই ভবিষ্যদ্বানীর প্রুতফলন ঘটেছিল। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে জার দ্বিতীয় নিকোলাস চরম বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ইতিহাসে সেই বিপ্লবের নাম বলশেভিক বা রুশ বিপ্লব। এরপর দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নিকোলাসের পরিবারের সবাই নিহত হন। নিকোলাসের মৃত্যুর মধ্যদিয়েই রাশিয়ায় দীর্ঘদিনের জার শাসনের অবসান ঘটে।
প্রতিশোধের শিকার
উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনের কারনে রাসপুতিনের অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়। প্রিন্স ফেলিক্স ইউসুপভ, গ্র্যান্ড ডিউক দিমিত্রি প্যাভলোভিচ এমনই দুজন। প্রিন্স ফেলিক্স ইউসুপভজার দ্বিতীয় নিকোলাসের চাচাতো ভাই। তারাই রাসপুতিনকে খুন করার পরিকল্পনা করা হয়। রাসপুতিনের আরেক শত্রু ভ্লাদিমির পুরিশকেভিচ। তিনি ছিলেন রাশিয়ার পার্লামেন্ট ডুমার সদস্য।
১৯১৬ সালের ১৯ নভেম্বর। ওইদিন ডুমায় এক ক্ষুব্ধ বক্তব্য রাখেন পুরিশকেভিচ। সেখানে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জারের মন্ত্রীরা পুতুল নাচের পুতুলে রূপান্তরিত হয়েছেন। এই পুতুলগুলোর সুতা রয়েছে রাসপুতিন ও সম্রাজ্ঞী আলেক্সান্দ্রার কাছে। ফেলিক্স ইউসুপভ পার্লামেন্টে বসে তার এই বক্তব্য শোনেন এবং পুরিশকেভিচের সঙ্গে মিলে রাসপুতিনকে খুন করার উদ্যোগ নেন। পরিকল্পনাটি এমন ছিল ফেলিক্স ইউসুপভ রাসপুতিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে আসবে ইউসুপভের প্রাসাদে। সেখানে তাকে খুন করা হবে।
তারা জানতেন রাসপুতিন যৌনতা পছন্দ করেন আর এই দুর্ববলতাকে করেই তাকে খুন করা হবে। এ জন্য ফেলিক্স তার সুশ্রী স্ত্রী ইরিনাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চান।তবে ইরিনা এ কাজে রাজি হননি। পরে ইরিনার মিথ্যা উপস্থিতির কথা বলে রাসপুতিনের টোপ হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। পরিকল্পনা মাফিক নভেম্বরের দিকে ফেলিক্স বুকের ব্যথায় ভুগছেন এই বাহানায় রাসপুতিনের কাছে যান। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর আসে মোক্ষম সুযোগ। ঘটনার দিন রাসপুতিন ইরিনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখন ফেলিক্স রাসপুতিনকে বিষাক্ত সায়ানাইড মিশ্রিত পেস্ট্রি খেতে দিলেন।কিন্তু রাসপুতিন তা খেতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ফেলিক্স চিন্তায় পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর রাসপুতিনের মন কিছুটা পরিবর্তন হয়। তিনি সামান্য পেস্ট্রি খেতে রাজি হন। কিন্তু পেস্ট্রি খাওয়ার পরও কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া হয়নি রাসের। তখন তারা মদ খেতে শুরু করেন। মদেও বিষ মিশানো ছিল। কিন্তু এতেও কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না।
ফেলিক্স অধর্য্য হারান। উদগ্রীব ফেলিক্স এবার গ্র্যান্ড ডিউক দিমিত্রি প্যাভলোভিচের কাছ থেকে একটি পিস্তল নিয়ে আসেন। পিস্তল তাক করে রাসপুতিনকে বললেন, ‘গ্রেগরি এফিমোভিচ, আপনি বরং যিশুখ্রিস্টের ক্রুশের মডেলটির দিকে তাকান এবং প্রার্থনা করুন।’ এবার ফেলিক্স গুলি চালান। গুলিবিদ্ধ রাসপুতিন নিথর হয়ে পড়ে যান । এক ঘণ্টা পর ফেলিক্স লাশটি ধরে নাড়াচাড়া দিলেও কোনো সাড়া পাননি। তবে লক্ষ্য করেন, রাসপুতিনের বাম চোখটা খোলার জন্য স্পন্দিত হচ্ছে। তিনি তখনো বেঁচে ছিলেন। হঠাৎ রাসপুতিন লাফিয়ে উঠে ফেলিক্সের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তার কাঁধ ও ঘাড় জড়িয়ে ধরেন। ফেলিক্স আতঙ্কিত অবস্থায় নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘সে এখনো বেঁচে আছে’। ওই সময় পুরিশকেভিচ ওপর তলায় ছিলেন। তিনি ফেলিক্সের চিৎকার শুনে নিচে নামেন।ভয়ার্ত ফেলিক্স তখন কাঁপছেন। চেহারা ফ্যাকাশে, চোখ কুঠরি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল তার। রাসপুতিন এর ফাঁকে দেয়ালঘেরা আবাসস্থল পেরিয়ে দৌড়ে পালাতে থাকেন। পুরিশকেভিচ তার পিছু নেন। তিনি রাসপুতিনকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল কিছু গুলি তারপর হঠাৎ ঠিকই গুলি লক্ষ্য ভেদ করেছিল। গুলি রাসপুতিনের পিঠে লাগে। রাসপুতিন থেমে গেলে পুরিশকেভিচ আবার গুলি চালান। এবার গুলি লাগে রাসপুতিনের মাথায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাসপুতিন। তারপরেও মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন আর হামাগুড়ি দিয়ে চলছিলেন । কিন্তু পুরিশকেভিচ তাকে ধরে মাথায় লাথি মারতে থাকেন। এসময় উন্মাদের মতো আচরণ করছিলেরন পুরিশকেভিচ। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কিছু পুলিশ সদস্য ডিউটিরত ছিলেন। তারা গুলির শব্দ পেয়ে বিষয়টি দেখার জন্য এগিয়ে আসেন। তারা প্রিন্স ইউসুপভ ও তার চাকর বুজিনিস্কির কাছে গুলির আওয়াজ সম্পর্ক জানতে চাইলে বুজিনিস্কি জানায় সে কোনো আওয়াজ পায়নি।
পরে রাসপুতিনের লাশ প্যালেসের ভেতরে আনা হয়। রাসপুতিনের বিকৃত চেহারা দেখে ফেলিক্স ক্রুদ্ধ হয়ে যান। ক্রুদ্ধ ফেলিক্স ২ পাউন্ড ওজনের একটি ডাম্বেল হাতে নিয়ে রাসপুতিনের দেহে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন। ফেলিক্সকে যখন থামানো হলো তার দেহ ততক্ষণে রক্তরঞ্জিত হয়ে পড়ে। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যে এত কিছুর পরও রাসপুতিন মারা যাননি। তিনি আসলেই হয়তো রহস্য পুরুষ! কারণ মাথায় বুকে গুলির পরও তিনি বেঁচে ছিলেন। এরপর তার দেহের ওপর নানা রকম অত্যাচার চালানো হয়। শেষে ফেলিক্স ও পুরিশকেভিচ ক্লান্ত হয়ে রাসপুতিনের লাশ বরফ ঢাকা নদীর বরফ কেটে তার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়।
করুণ মৃত্যু
১৯১৬ সালে রাশিয়ার এই প্রভাবশালী সন্ন্যাসী রাসপুতিনের মরদেহ বরফের নিচে পানির মধ্য থেকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে তার এই মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়। তার মৃত্যু যে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড তা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়। রাসপুতিনের দেহ নদীতে জমাট বরফ কেটে গর্ত করে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হত্যার আগে তার শরীরে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এমনকি অস্ত্রোপচার করে তাকে পুরুষত্বহীনও করা হয়েছিল। আসলে বহু নারীতে আসক্ত রাসপুতিনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল তার খুনিরা। তার মাথা, ফুসফুস ও কলিজায় উপর্যুপরি আঘাতের চিহ্ন ছিল। উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন, অতিমাত্রায় অ্যালকোহল পান, নারীর প্রতি আসক্তি নানা কারণে তার প্রতি ক্ষোভ জন্মেছিল অনেকের। ফলে এক করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল ইতিহাসের রহস্য পুরুষখ্যাত সন্ন্যাসী রাসপুতিনকে।