অনিন্দ্য আফরোজ
শাহ কুলি খান মির্জা মোহাম্মদ হায়বৎ জং বাহাদুর বা মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজ-উদ-দৌলা, যিনি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা নামেই অধিক পরিচিত।তিনি স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব। ইংরেজ বনিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় গুপ্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারনে খুব অল্প বয়সেই প্রাণ হারাতে হয়েছিল সিরাজ-উদ-দৌলাকে।
নানা নবাব আলীবর্দী খানের স্নেহধন্য সিরাজ মাত্র ২২ বছর বয়সে মুর্দিদাবাদের নবাব হিসেবে ১৭৫৬ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। ক্ষমতায় আরোহণের পরই প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হন স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। সেইসঙ্গে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। তাঁর পতনের মধ্যদিয়ে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইতিহাসে নানা কারনে অমর হয়ে আছেন। ব্যক্তিগত বীরত্ব, প্রণয় বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেছার প্রতি তাঁর গভীর প্রেম তাঁদের অমর করে রেখেছে। যদিও সিরাজের করুণ পরাজয় ও মৃত্যুর পর লুৎফুন্নেছা ও মেয়ে এবং সবাব পরিবারকে নানাভাবে নিগৃহিত হয়ে হয়ে। চরম দারিদ্র্য-নিপিড়নে তাঁদের মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়। ইংরেজ ও এবং তাদের দোসররা ক্ষমতা দখলের পর স্বাদীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে তাঁর প্রতি মানুষের আগ্রহকে ভিন্নদিকে ধাবিত করার অপপ্রয়াস হয়েছে। এখনো সেই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। কিন্তু এতো বছর পর সিরাজের মৃত্যু, লুৎফুন্নেছার গভীর প্রেম মৃত্যুর ঘটনা ইতিহাসে মর্মন্তুদ অংশ হিসেবে নতুন করে আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে ইতিহাসের প্রতি উৎসাহী পাঠকের কাছে। এবারের আয়োজন সিরাজ-উদ-দৌলার জীবন, মৃত্যু, প্রেম নিয়ে জানাচ্ছেন অনিন্দ্য আফরোজ।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের কোনো ছেলে ছিল না। তিন মেয়ে বাবা ছিলেন তিনি। এজন্য তিনি তিন মেয়েকেই তাঁর বড় ভাই হাজি আহম্মদের তিন ছেলে নওয়াজেশ মোহাম্মদরে সঙ্গে বড় মেয়ে ঘষেটি বেগম, সাইয়েদ আহাম্মদের সঙ্গে মেঝ মেয়ে এবং জয়েন উদ্দীন আহাম্মদেরে সঙ্গে ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের বিয়ে দেন। ছোট মেয়ে আমেনার দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। বড় ছেলে সিরাজ-উদ-দৌলা, ছোট ছেলে মির্জা মেহেদি। আলীবর্দী খান যখন পাটনার শাসনভার গ্রহণ করেন তখন আমিনার গর্ভে ১৭৩২ মতান্তরে ১৭৩৩ সালে সিরাজের জন্ম হয়। এজন্য আলীবর্দী খান সিরাজের জন্মকে সেভৈাগ্যের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে শিশু সিরাজকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তারপর থেকে নানার কাছেই লালিত-পালিত হতে থাকেন সিরাজ। এরপর নানা আলীবর্দী খান সিরাজকে তাঁর উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। মাত্র ২২ বছর বেয়সে তিনি ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাবের ক্ষমতা অর্জন করেন।
যুদ্ধ জয়
১৭৬৪ সালের কথা। ওই বছর সবাব আলীবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ান। কিশোর সিরাজ তাঁর সারথী হন। ওই যুদ্ধে জয়ের পর আলীবর্দী খান কিশোর সিরাজকে পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় রাজা জানকিরামকে রাজকার্য পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। এতে সিরাজ অন্তুষ্ট হন। সিরাজ একদিন কাউকে কিছু না বলে গোপনে তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে স্ত্রী লুৎফুন্নেছাকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণের নাম করে মুর্শিদাবাদ থেকে বের হন। তিনি সোজা চলে যান পাটনায়। পাটনার রাজদরবারে হাজির হয়ে তিনি জানকিরামকে রাজ্যভার ছেড়ে দেওয়ার আদেশ করেন। কিন্তু নবাবের অনুমতি ব্যতিরেখে জানকিরাম তা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে সিরাজ রাজ্য দূর্গের দ্বার বন্ধ করে দিয়ে নবাব আলীবির্দী খানের কাছে বিস্তারিত জানিয়ে দূত পাঠান। একইসঙ্গে জানকিরামের আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় ক্ষুব্ধ সিরাজ পাটনা দুর্গ আক্রমন করেন। শুরু হয় উভয়পক্ষে লড়াই। এতে উভয়পক্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। খবর পেয়ে আলীবর্দী খান দ্রুত পাটনায় এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন। সেদিনই আলিবর্দী খান দুর্গের অভ্যন্তরের দরবারে সিরাজকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন, আমার পর সিরাজই হবে বাংলা-বিহার-উড়িষার পরবর্তী নবাব।
বাংলার সিংহাসনে আরোহণ
১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খান মৃত্যুবরণ করেন। মূলত ওইদিনই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন নতুন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। সিরাজ যখন ক্ষমতায় আরোহণ করেন তখন বাংলার মসনদে কঠিন দুর্যোগময় পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ঠিক এমন এক দুর্যোগময় মুহূর্তেই সিরাজ ক্ষমতায় আসীন হন। বরে রাখা ভাল, ১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করা হয়। ওই সময় থেকেই নবাবগণ মুর্শিদাবাদে অবস্থান করতেন এবং বাংলাদেশের জন্য তখন থেকেই একজন নায়েব নাজিম নিযুক্ত করা হত। মুর্শিদকুলী খানের জামাতা সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান ১৭২৭ থেকে ১৭৩৯ সাল অবধি সুবাহ বাংলার নবাব হিসেবে মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলা শাসন করেন। তাঁর শাসনামলে তাঁরই ছেলে সরফরাজ খান ১৭৩৪ থেকে ১৭৪০ সাল পর্যন্ত ঢাকার নায়েব নাজিমের পাশাপাশি ১৭৩৯ থেকে ১৭৪০ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের নবাবের দায়িত্বে ছিলেন। ওই সময় (১৭৩৯-১৭৪০) ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন আবুল ফাত্তাহ খান। ১৭৪০ থেকে ১৭৪৪ পর্যন্ত আলীবর্দী খানের বড় ভাইয়ের ছেলে ও জামাতা নওয়াজিশ মুহাম্মদ খান নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন। তবে তিনি মুর্শিদাবাদে অবস্থান করে তাঁর সহকারী হোসেন কুলী খান এবং হোসাইন কুলীর সহকারী হোসেন উদ্দিন খানকে (১৭৪৪-১৭৫৪) ঢাকায় নায়েবে নাজিমের দায়িত্ব পালন করান। এ সময় থেকেই আলীবর্দীর ভাইয়ের অপর ছেলে শওকত্জংগ নওয়াজিস মুহাম্মদের বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধের জের ধরে ঢাকায় হোসেন উদ্দিন খান এবং মুর্শিদাবাদে তার চাচা নিহত হন। ঢাকায় হোসেন উদ্দিন খানকে হত্যায় জড়িত ছিলেন আগা সাদেক এবং আগা বাখের। আগা বাখের ছিলেন বাখরগঞ্জের (বরিশাল অঞ্চল) জমিদার এবং তাঁর ছেলে আগা সাদেক। হোসেন উদ্দিন খানের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আগা সাদেক মুর্শিদাবাদে হোসেন কুলী খানের হাতে বন্দি হন। সেখান থেকে ঢাকায় পালিয়ে এসে তিনি হোসেন কুলী খানকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। অত্যন্ত সৎ এবং ধার্মিক হোসেন কুলী খানকে রাতের আঁধারে তাঁর প্রাসাদে ঢুকে নির্মমভাবে করে হত্যা করা হয়। সকালে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে শহরের অধিবাসীরা একত্রিত হয়ে মারমুখী হয়ে ওঠেন এবং আগা বাখের ও তার ছেলেকে আক্রমণ করে। তারা নায়েব নাজিমের পদে নিয়োগের বিষয় বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করলে লোকেরা নায়েব নাজিম পদে নিয়োগের সনদ প্রদর্শনের দাবি করে।তা প্রদর্শন না করে তারা তরবারি হাতে নেয়। এ অবস্থায় জনতার আক্রমণে আগা বাখের প্রাণ হারান এবং আগা সাদেক মারাত্মক আহত অবস্থায় পালাতে সক্ষম হযন।নওয়াজেশের পরমবন্ধু ছিলেন হোসেন কুলি খাঁ ও রাজা রাজবল্লভ। হোসেন কুলি খাঁ ছিলেন নওয়াজেশের ধনভান্ডারের দায়িত্বে। তাঁর হত্যাকাণ্ডে রাজা রাজবল্লভ কিছুটা ভীতু-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তখন তিনি আরেক ষড়যন্ত্র শুরু করেন। নওয়াজেশ নিঃসন্তান ছিলেন বলে তিনি সিরাজের ছোটভাই মির্জা মেহেদীকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেছিলেন।কিন্তু মির্জা মেহেদী নওয়াজেশের জীবদ্দশাতেই মারা যান। কিন্তু তাঁর কম বয়সী এক ছেলে ছিল। রাজবল্লভ তাকেই সিংহাসনে বসিয়ে ঘসেটি বেগমের নামে স্বয়ং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবি করার স্বপ্ন দেখছিলেন। এইরকম দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেই আলিবর্দী খান ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
আলিবর্দী খানের মৃত্যুর পর চারদিকে শুরু হয় তীব্র অরাজকতা। পাশাপাশি ইংরেজদের গোপন মিশনের পৃষ্ঠপোষকতায় নবাব পরিবার, রাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। ইংরেজরা নবাবের অনুমতি না নিয়েই কলকাতায় দুর্গ সংস্কার করা শুরু করে। দুষ্টচত্রের অন্যতম হোতা রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমকে সহায়তা করার জন্য তার চেলে কৃষ্ণবল্লভকে ঢাকার রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থসহ কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠায়। এ রকম পরিস্থিতিতেই ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
নবাব হিসেবে কার্যাবলী
সিরাজ-উদ-দৌলা যখন সিংহাসনে আরোহণ করার পর থেকেই কলকাতায় ইংরেজদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। সিরাজ তাদের দমন করার জন্য কাশিমবাজার কুঠির কুঠিয়াল ওয়াটসনকে কলকাতার দুর্গপ্রাচীর ভেঙে ফেলতে ও ভবিষ্যতে নবাবের অনুমতি ছাড়া এ ধরণের কাজ না করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ওয়াটসন নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে কাজ অব্যাহত রাখেন। সিরাজ তখনই বুঝতে পারলেন গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা উদ্ধত আচরণ করছে। এ জন্য প্রথমেই নবাব সিরাজ তাঁর খালা ষড়ডন্ত্রকারী ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ণ করতে সচেষ্ট হন। তিনি মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করে ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। মতিঝিল অধিকার করে নবাব কাশিমবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২৭ মে সিরাজের সেনাবাহিনী কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ করে। তিনি কাশিমবাজার দুর্গের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে দরবারে হাজির হয়ে তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখতে বলেন। ওয়াটসন এই অঙ্গীকারপত্র লিখতে বাধ্য হন।
এরপর একই বছরের ১৮ জুন সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেন। তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পর ২০ জুন কলকাতা দুর্গ সিরাজের দখলে আসে। তিনি দুর্গ প্রবেশ করে এবং দরবারে উপবেশন করে উঁমিচাঁদ ও কৃষ্ণবল্লভকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দেন। এরপর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজ-রাজধানীতে ফিরে আসেন। ১২ জুলাই তিনি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
নবাবগঞ্জের যুদ্ধ
নবাবগঞ্জের যুদ্ধ ছিল নবাব াসরাজের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দিল্লীর বাদশা যখন পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবি সনদ পাঠান তখন শওকত জঙ্গ নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ইংরেজরা এমন সংবাদ পেয়ে গোপনে শওকত জঙ্গের সঙ্গে মিত্রতার চেষ্টা চালায়। অপরদিকে মাদ্রাজের ইংরেজ দরবার কর্নেল রবার্ট ক্লাইভকে সেনাপতি নিয়োগ করে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধে পাঠায়। সিরাজ-উদ-দৌলাও পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে প্রতিরোধ করার জন্য রণযাত্রা করেন। পথিমধ্যে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে উভয়পক্ষ মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হলে যুদ্ধে শওকত জঙ্গ নিহত হন।এরপর সিরাজ-উদ-দৌলা সেনাপতি মোহনলালের হাতে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পণ করে রাজধানীতে গমন করেন।
অন্যদিকে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ এবং ওয়াটসন কলকাতা অভিমুখে রওনা হন। প্রায় বিনাযুদ্ধে তারা কলকাতা দুর্গ জয় করে নেন। এর আগে রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতায় এসে সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেনিআর সিরাজ তাতে সম্মতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা সেই শর্ত ভঙ্গ করে আকষ্মিক কলকাতা আক্রমণ করে। সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর মন্ত্রীদের কুচক্রের বিষয়ে শংকিত হয়ে পড়েন এবং এ কারণে ইংরেজদের সঙ্গে একটি সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। তাই ইংরেজদের সকল দাবিতে রাজি হয়ে তিনি ১৭৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইংরেজদের সঙ্গে একটি সন্ধিতে সই করেছিলেন। ঐতিহাসিক ‘আলিনগরের সন্ধি’ নামে পরিচিত। কিন্তু সিরাজের সঙ্গে সন্ধি করলেও ইংরেজরা তাদের ইচ্ছার কোনো পরিবর্তন করল না। মূলতঃ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাফরাসিদের সঙ্গে। সিরাজদ্দৌলা ফরাসিদের বেশি প্রাধান্য দিতেন।যুগপৎ সম্পর্ক রাখতে গিয়ে আলিনগরের সন্ধির প্রতিশ্রুতি পালনে নবাব সিরাজকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল ওই সময়।
কুচক্রী সেনাপতিদের বিচার এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া
বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা রাজ্যের সব ধরনের গোলযোগ নিরসন করে মোটামুটি শান্ত হওয়ার পর নবাব সিরাজ সেনাপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন। তিনি মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দী করার আদেশ দেন। এটা দেখে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মীর জাফর আলী খানের মতো ষড়যন্ত্রকারীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জগৎশেঠের মন্ত্রণাভবনে মিলিত হয়ে তাঁরা ইংরেজদের সাহায্যে নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে আরোহণ করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা ইয়ার লতিফকে গোপনে ওয়াটসনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুমন্ত্রণা দিলেন যে, সিরাজদ্দৌলা খুব শিগগিরই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর এই কারণেই তিনি পলাশিতে শিবির স্থাপন করেছেন। ক্লাইভ এরপর তাঁর সেনাবাহিনীর অর্ধেক লুকিয়ে রেখে বাকিদের নিয়ে কলকাতায় পৌঁছালেন। আর নবাব সিরাজকে এই বলে চিঠি লিখলেন,‘ আমরাকেলকাতা থেকে সব সৈন্য তুলে আনলাম আর আপনি পলাশিতে ছাউনি গেড়ে বসেছেন’?
চিঠি পাওয়ার পর সিরাজ সরল বিশ্বাসেমিীরজাফরকে পলাশী থেকে ছাউনি গুটিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যাবার নির্দেশ দিলেন। এরপর সেনাপতি মীরজাফর আরী রাজধানী মুর্শিদাবাদে পৌঁছামাত্রই স্ক্রাফটন তার সঙ্গে মিলিত হয়ে গোপন সন্ধির খসড়া লিখে নিলেন। ১৭ মে কলকাতার ইংরেজ দরবারে এই গোপন সন্ধিপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য এই গোপন সন্ধিপত্র ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গুপ্ত বৈঠক গোপন থাকলো না। ক্লাইভ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এদিকে গোপন সন্ধিপত্রের সংবাদ জানতে পেরে সিরাজদ্দৌলা মীরজাফরকে বন্দী সিদ্ধান্ত নিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ওয়াটসন রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়ে গেলেন।
পলাশীর যুদ্ধ
১৭৫৭ সালের ১২ জুন। কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের জন্য যাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করল না। নবাব সিরাজ বুঝতে পারলেন, তাঁর সেনাপতিরাও ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ –উদ-দৌলা মীরজাফরকে বন্দী করার চিন্তা বাদ দিলেন। তিনি মীরজাফর আলীকে ক্ষমা করে তাঁকে শপথ নিতে বললেন। মীরজাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করলেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে তিনি রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীরজাফর.মীরমদন, মোহনলাল ও ফরাসী সেনাপতিদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।
২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা বাংলার নবাবের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। ইংরেজ সেনারা লক্ষবাগের আমবাগানে সৈন্য সমাবেশ করে। সকাল ৮ টার দিকে হঠাৎ করেই মীরমদন ইংরেজবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করেন। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেয়। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মীরমদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই তারা নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাঁদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মীরমদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজ-উদ- দ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীরমদন ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীরমদন লুটিয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন।
মীরমদনের মৃত্যুর পরেও অন্যতম সেনাপতি মোহনলাল বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে গিয়ে ইংরেজবাহিনীকে আক্রমণের পক্ষপাতী ছিলেন।
কিন্তু মীরজাফর আবারও বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সৈন্যবাহিনীকে শিবিরে ফেরার নির্দেশ দেন। এই সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা নবাব সিরাজকে আক্রমণ করে। যুদ্ধ বিকেল পাঁচটায় শেষ হয় এবং নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে চলে আসে। ইংরেজদের পক্ষে সাতজন ইউরোপিয়ান এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়। তখন কোনও উপায় না দেখে সবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যও কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি। উপাযান্ত না পেয়ে সিরাজ-উদ-দ্দৌলা তাঁর সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা,মহানন্দার মধ্যদিয়ে উত্তরদিকে যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিয়ে নাসের সহয়তায় তিনি পাটনা গিয়ে গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি গৃহষড়যন্ত্রের শিকার বাংলার শেষ নবাবের। তিনি বন্দী হলেন।
বন্দিত্ব এবং মৃত্যু
বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর আলী পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে পৌঁছে নবাবকে খুঁজে না পেয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই সিরাজ-উদ-দ্দৌলা মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তাঁর নৌকা চরে আটকে পড়ে। নবাব সেখানে নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে আসেন। সেখানে কিছু লোক তাঁকে চিনে ফেলে অর্থের লোভে মীর কাশিমের সেনাবাহিনীকে খবর দেয়।
তবে এনিয়ে ভিন্নমতও প্রচলিত আছে যে, এক ফকির এখানে নবাবকে দেখে চিনে ফেলে। ওই ফকির অনেক আগে নবাবের দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে তার এক কান হারিয়েছিল। সেই ফকির নবাবের খবর জানিয়ে দেয়। খবর পেয়ে মীর কাশিমের সেনাবাহিনী এসে সিরাজ-উদ-দ্দৌলাকে বন্দী করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। বন্দী হওয়ার সময় নবাবের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী লুতফুন্নেছা বেগম এবং চার বছর বয়সী মেয়ে উম্মে জহুরা। এর পরের দিন অর্থ্যাৎ ৪ জুলাই (মতান্তরে ৩ জুলাই) বিশ্বাসঘাতকমীরজাফরের আদেশে তারছেলে মিরনের নেতৃত্বে মুহাম্মদিবেগ নামে এক ঘাতক নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কথিত আছে,সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হযয়েছিল।হত্যার পর স্বাধীন বাংলার শেষ এই নবাবকে রাজধানী মুর্শিদাবাদের খোশবাগে তাঁর নানা নবাব আলিবর্দী খানের কবরের পাশে সিরাজকে সমাহিত করা হয়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মর্মন্তুদ মৃত্যুর মধ্যদিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
পরিবারের পরিণতি
সিরাজের মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং তাঁর শিশুকন্যাকে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের ছেলে মিরনের নির্দেশে ঢাকায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সিরাজের পতনের আগ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজের খালা ঘষেটি বেগমকে ব্যবহার করলেও সিরাজের পতনের পর আর তাঁকে কোনো সুযোগই দেওয়া হয়নি। এ সময় তাঁরা তাঁদের মা শরফুন্নেসা, সিরাজের মা আমেনা, খালা ঘষেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর শিশুকন্যা সবাইকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করেরাখে। ঢাকার বর্তমান কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা প্রাসাদে তাঁরা বেশ কিছুদিন বন্দী জীবন যাপন করার পর মিরনের নির্দেশে ঘষেটি বেগম ও সিরাজের মা আমেনা বেগমকে নৌকায় করে নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়। ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে শরফুন্নেসা, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং তাঁর শিশুকন্যা রক্ষা পায় এবং পরবর্তীতে তাঁদেরকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে আনা হয়। ইংরেজ কোম্পানি সরকারের দেওয়া সামান্য বৃত্তির ওপর নির্ভর করে তাঁদেরকে খুব মানবেতর জীবন ধারণ করতে হয়। সিরাজের মৃত্যুর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর লুৎফুন্নেসা ১৭৯০ সালে ধুকে ধুকে স্বামীর কবরের পাশে মৃত্যুবরণ করেন।