‘দ্য রেইপ অব নানচিং’-পৃথিবীর নৃশংসতম গণহত্যা

মার্চ ২০, ২০১৯
Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

মানব ইতিহাসে  নৃশংসতার এক নগ্ন উদহারণ হচ্ছে নানচিং গণহত্যা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হায়েনারা যেভাবে নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালী নর-নারী-শিশুদের ওপর নির্মম ও জঘন্য গণহত্যা, ধর্ষণের মতো পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিলো, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাবাহিনী এমন এক নির্মম গণহত্যা চালায় চীনের তৎকালীন রাজধানী নানচিংয়ে

হিটলারের পৈশাচিকতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা গণমাধ্যমের জোড়ালো আলোচনায় যদিও বিষয়টি অতটা আলোচনায় আসেনি। বলতে গেলে পৃথিবীর এই জঘন্য ও ভয়াবহতম হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস চাপা পড়ে গিয়েছিল।ফলে এমন নারকীয় অনেক গণহত্যার কাহিনী ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে যেতে বসেছিল।ইতিহাসের বিবর্ণ পাতাগুলো খোলা প্রয়োজন। এটা একটি ঐতিহাসিক দায়। এই দায় থেকেই আমাদের এই ভয়াবহ ইতিহাসের পাঠ অত্যন্ত জরুরী। হিটলারের মিত্র জাপানি সেনারা  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে  চীনে যে নারকীয় হত্যা ও ধর্ষণযজ্ঞ চালিয়েছিল তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই গণহত্যাকে ‘দ্য রেইপ অব নানচিং’ নামেও অভিহিত করা হয়।  

নানচিং গণহত্যা কী, কেন?

১৯৩৭ সালের শেষ দিকের ঘটনা। তখন  ইউরোপ জার্মান সামরিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যস্ত ছিল। এ সময় জাপানের সেনারা  চীন দখল করতে শুরু করে। জাপান  তাদের দেশের সীমানা বাড়ানোর জন্য খুব উদগ্রীব । শুরুতে  চীন একা থাকলেও পরবর্তীতে মিত্র বাহিনীর সহায়তা নিয়ে যুদ্ধের সময় চীন পাল্লা দিয়ে জাপানের সঙ্গে  লড়াই করে যাতে প্যাসিফিক ও ইস্ট এশিয়ায় জাপানিদের  প্রভুত্ব  রোধ করা যায়। এই সময়ই জাপানি সেনারা চীনের তৎকালীন রাজধানী নানচিং দখলের্ অভিযান শুরু করে। 

নানচিং গণহত্যা যা ইতিহাসে নানচিং ধর্ষণ নামেও পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে চীন-জাপান যুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৭-৩৮ সালে রাজকীয় জাপান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত হয় এই গণহত্যা। এই গণহত্যাযজ্ঞ  চালানে হয় তৎকালিন চীনের রাজধানী নানচিংয়ের (১৯১২-৪৯) বাসিন্দাদের ওপর। ছয় সপ্তাহ ধরে চলা এই গণহত্যা শুরু হয় ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। এই সময়ে জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী অন্তত চার লাখ নিরীহ চীনা নারী, পুরুষ, শিশুকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়।  এসময় ব্যাপক ব্যাপক লুটপাট ও  লোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।  ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর, অনেকদিন অবরোধের পর  অ্ন্তত দেড় লাখ জাপানি সেনা চীনের রাজধানী শহর নানচিং দখল করে নেয়। এরপর কয়েক সপ্তাহ ধরে শহরটিতে এক অবিশ্বাস্য ও নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। জাপানি সেনারা কখনো পরিকল্পিতভাবে, কখনো  বিজয়রে উল্লাসে  অনির্দিষ্টভাবে শহরটির বাসিন্দা চীনা বেসামরিক লোকদের হত্যা ও ধর্ষণ করা শুরু করে। এভাবে অন্তত চার লাখ চীনাকে হত্যা সেই সঙ্গে ধর্ষিত হন নানচিংয়ের হাজার হাজার নারী, কিশোরী ও শিশু।

এমন বর্বরতার কারণ

চীনা নগরিকদের ওপর জাপানি সেনাদের এমন ভয়াবহ উৎপিড়র আর বর্বরতার পরিষ্কার কোনো কারণ পাওয়া যায় না। ধারণা করা হযয়ে থাকে, নানকিং দখল করতে প্রচুর লোকবল ও সময় ব্যয় হওয়ায়, আত্ম অহমিকায় অন্ধ জাপানি বাহিনী প্রতিশোধ স্পৃহার এমন কাণ্ড ঘটায়। তারপরও একটি যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পেছনে  সাধারণত যে সকল গূঢ় কারন থাকে তার কোনটিই নানকিং অভিযানের পেছনে ছিল না। আর এই বর্বরতার পেছনে কোনো যুক্তিও খুঁজে পাওয়া যায় না।

১৯৪৬ সালে জাপানের রাজধানী টোকিওতে গঠিত আন্তার্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভাষ্য অনুযায়ী, এই গণহত্যায় দুই লাখের অধিক  চীনা বেসামারিক মানুষকে হত্যা করা হয়। আর ১৯৪৭ সালে চীনে গঠন করা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভাষ্য অনুযায়ী, জাপানি সেরারা এই গণহত্যায় তিন লাখের বেশি নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করে।  

আরো পড়ুন..জোসেফ গোয়েবলসঃ প্রপাগান্ডার জাদুকর

 আর জাপানের তৎকালীন সরকার ও ওই  সমযয়ে নানচিং অভিযানে যে সব সেনাসদস্য  অংশ নেয়   তাদের অনেকেই স্বীকার করেছিলেন যে সেখানে, এমন  বর্বর গণহত্যা, ধর্ষন ও লুটপাটের মত যুদ্ধাপরাধ  হয়েছিল।

কিছু লোমহর্ষক ঘটনা

তৎকালীন  জাপানি এক  সাংবাদিকের বর্ণনায় পাওয়া যায়, দশম বাহিনীকে এই মর্মে মৌন সম্মতি দেওয়া হয় যে, তারা যত দ্রুত নানচিং পৌছতে পারবে তত বেশি লুট ও নারী ধর্ষনের সুযোগ পাবে। এতে সেনারা আরো বেশি উৎসাহিত হয়।  জাপানি সেনারা  নানচিং দখল করার পর সেখানকার সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন  দেয়। পথে সব ব্যাক্তিকে পেয়েছে তাদের  বেয়োনেট অথবা বিশেষ সামরিক তরবারি দিয়ে নির্মমভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।

জাপানি ঔপন্যাসিক তাৎসুজো ইশিকাওয়া তার ‘ইকিতেইরু হেইতেই’ (বেঁচে থাকা সৈন্যরা) উপন্যাসে নানকিনংয়ে  জাপানি সেনাদের এমন  ভয়াবহ অত্যাচারের চিত্র  তুলে তুলেছেন।  ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে জাপানি সেনাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তাৎসুজো এই  উপন্যাসটি  লিখেন।

পরে তাঁর এই উপন্যাস নোবেল পুরস্কার পায়।  উপন্যাসে তিনি বর্ণনা করেন. তখনকার জাপানি সেনাবহিনীর ১৬ তম ডিভিশনের সেনাদের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন। উপন্যাসটিতে তিনি উল্লেখ করেন, এসময় দুজন জাপানি সামরিক কর্মকর্তার মধ্যে সংগঠিত নরহত্যার প্রতিযোগিতাটি তৎকালিন জাপানি সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচারিত হত। প্রতিযোগিতাটি ছিল, শুধুমাত্র একটি তরবারি দিয়ে নরহত্যার সংখ্যা ১০০ জনে উন্নিত করা। এছাড়া এই নৃশংস অভিযানে  বহু সংখ্যক চীনা বেসামরিক মানুষকে জীবন্ত কবরস্থ হরা হয়।  দুগ্ধপোষ্য শিশুদের ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে তরবারি দিয়ে বিদ্ধ করে হত্যার মতো লোমহর্ষক ঘটনাও ঘটে।

মিনি ভট্রিন নামে অপর এক  মার্কিন নাগরিকের বর্ণনায়ও নানকিংয়ে জাপানি সেনাদের নিষ্ঠুরতার  চিত্র পাওয়া যায়।তিনি ও সময় চীনের রাজধানী নানকিংয়ের  জিনলিং মহিলা  কলেজের ডিন ছিলেন ।

ভট্রিনের বর্ণনা এমন, যুদ্ধের প্রথম দিন ১৩ ডিসেম্বর প্রায় ৩০ জন সৈন্য নানচিংয়ের  দক্ষিণ-পূর্ব অংশে হসিং লু কুতে একটি চীনা বাড়িতে আসে। তারা বাড়িটির ভেতরে   প্রবেশ করার সুযোগ চায়। হা নামের একজন  দরজা খোলেন। সেনারা ভেতরে ঢুকেই প্রথমেই   রিভলভার দিয়ে হা-কে হত্যা করে। ঘটনায় হতবিহ্বল  হা-এর স্ত্রী মিসেস হসিয়া  জাপানি সেনাদের  সামনে হাঁটু গেড়ে বসেন। তিনি আর কাউকে হত্যা না করার জন্য অনুরোধ করেন। মিসেস হাসিয়া তাদের কাছে জানতে চান, কেন তারা তাঁর স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। এমন প্রশ্ন করতেই সেনারা  তাঁকে গুলি করে। মিসেস হসিয়াকে গেস্ট হলের একটি টেবিলের নিচ থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনা হাসিয়া তিনি তাঁর  এক বছর বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনার পর  তাঁকে নগ্ন করার হয় এবং এক বা একাধিক সৈন্য তাঁকে ধর্ষণ করার পর তাঁর বুকে বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তাঁর যোনির মধ্যে একটি বোতল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আর তাঁর এক বছর বয়সী শিশুটিকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে  হত্যা করা হয়।

এরপর কিছু সৈন্য আরেকটি কক্ষে যায়, সেখানে মিসেস হসিয়ার বৃদ্ধ বাবা-মা আর তাঁর  ১৬ ও ১৪ বছর বয়সী দুই মেয়ে ছিল। সৈন্যরা তাদেরকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে তাদের নানি তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। সৈন্যরা গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর  বৃদ্ধ স্বামী স্ত্রীর দেহ আঁকড়ে ধরেন এরপর তাঁর ওপরেও গুলি চালানো হয় এবং  তাঁকেও হত্যা করা হয়। এরপর  হাসিয়ার দুই মেয়েকে ধরে সেনারা  নগ্ন করে। এরপর বড় মেয়েকে ২–৩ জন এবং ছোট মেয়েটিকে তিন জন মিলে ধর্ষণ করে। বড় মেয়েটিকে এরপর বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তার যোনিতে একটি বেত প্রবেশ করানো হয়। ছোট মেয়েটিকেও বেয়োনেটবিদ্ধ করা হয় কিন্তু তার মা ও বোনের সঙ্গে যে ভয়ানক আচরণ করা হয়েছে তা থেকে তাকে রেহাই দেওয়া হয়। এরপর সৈন্যরা ওই কক্ষে থাকা তাদের ৭–৮ বছর বয়সী আরেক বোনকে বেয়োনেটবিদ্ধ করে। বাড়িটির শেষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় হাসিয়ার  চার ও দুই বছর বয়সী দুই ছেলে। বড় ছেলেটিকে বেয়োনেটবিদ্ধ করা হয় এবং ছোটটির মাথা তরবারি দিয়ে কেটে ফেলা হয়।

চ্যাং ঝি কিয়াং নামে ১২ বছরের এক শিশু  তার মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে পালাচ্ছিল। পথে তাদেরকে আটক করে সেনারা।  সেনারা চ্যাং ঝি কিয়াং মাকে ধর্ষণ করতে চায়।   শিশু কিয়াং  তাতে বাধা দিলে তাকে ধরে ছুড়ে দূরে ফেলে দেয় সেনারা।  এরপর তার মাকে বিবস্ত্র হতে বলে। কিয়াংয়ের মা তা না করলে তাঁর স্তনে বেয়োনেট দিয়ে সজোরে আঘাত করে। এতে তার মা অজ্ঞান  হয়ে গেলে  মৃত ভেবে সেনারা তাঁকে রেখে চলে যায়। এরপর কিয়াং কাছে গিয়ে তার মাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করে। তার বুকের ক্ষত পরিমাপ করতে কাপড় সরাতেই তার পাশে ছোট  ক্ষুধার্ত  ভাইটি মায়ের স্তনে মুখ দেয়। কিন্তু তার মুখ দুধের বদলে ভরে ওঠে রক্তে! তখন তার মা  না ফেরার দেশে চলে গেছে।

ঝ্যাংয়ের বাবা-মা দুজনই প্রাণ হারিয়েছে জাপানি সেনাদের হাতে। একদিন সেনারা  তাদের বাড়িতে  এসে ঝ্যাংকে  নিয়ে যেতে চায়। তার দাদা এতে বাধা দিলে তাকে হত্যার হুমকি দেয় সেনারা। তবু ঝ্যাংকে ছাড়তে চায় না তার দাদা। তিনি নাতিকে বুকে আগলে ধরে বলছিলেন, ‘উৎসর্গকরার মতো বয়স এখনো হয়নি তোমার’।

ঝ্যাং জানতো সেনাদের সঙ্গে না গেলে  দাদা ও তাকে দুজনকেই  প্রাণ হারাতে হবে। এর চেয়ে একজনের প্রাণ যাওয়া অনেক উত্তম। এরপর ঝ্যাং দাদার প্রবল বাধা সত্ত্বেও  সৈন্যদের সঙ্গে যায়। এরপর সেনারা পাশের কক্ষে নিয়ে তাকে পাশবিক ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে অজ্ঞান ঝ্যাংকে সৈন্যরা রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যায়। মাত্র ৪২ দিনে এমন লাখ লাখ নারী, শিশু, পুরুষ  বর্বর জাপানি বাহিনীর নির্মমতার  শিকার হয়।

জর্জ ফিচ নামে একজন নানকিংয়ে তখন মিশনারির দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর  ভাষ্য এমন ‘ওই সময় নানকিং মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল। মানুষের পালানোর মতো জায়গা ছিল না। চোখের সামনে আমি বহু বেসামরিক লোককে হত্যা করতে দেখেছি। গুলি করে হত্যার পাশাপাশি বহু মানুষকে শিরশ্ছেদও করা হয়েছে।’

এমনকি বৌদ্ধ উপাসনালয়গুলোতে হানা দিয়ে এর অভ্যন্তরে ধর্ষণ করা হয়েছিল জাগতিক বোধ বিবর্জিত সন্ন্যাসিনীদেরও। বহুল প্রচারিত ‘দাবাং ’ পত্রিকা এ সম্পর্কে  লিখেছে, ‘দিনের চব্বিশ ঘন্টার এমন কোন ঘন্টা ছিল না যখন একজন নিরীহ নারীকে ধর্ষণের উদ্দেশে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল না কোন না কোন জাপানী সৈনিক”।

বৃদ্ধ বয়সটা নিয়েও কোনো মাথাব্যাথা ছিল না বর্বর সেনাদের।ধর্ষণের নজির পাওয়া গেছে  বয়স ৮০ এর ওপরে প্রবীণ নারীদের। প্রবীন নারীদের ওপর এমন আচরণ থেকে বোঝাই যায়, বালিকা, তরুণী, কিশোরীদের সঙ্গে কতটা ভয়ংকর আচরণ করা হয়েছিল।ধর্ষণের শিকার বালিকাদের বেশিরভাগই মারা গিয়েছিল। যারা ধর্ষণে মারা যায়নি তাদের দু টুকরো করে ফেলা হয়েছিল। কিছু কিছু ঘটনার বিবরণ এমন  ছিল, পেডোফলিক জাপানি সেনারা মেয়ে শিশুদের যোনিপথ ছুরি দিয়ে চিড়ে নিয়েছিলো ধর্ষণকর্ম সহজভাবে সম্পন্ন করতে। নানকিংয়ে জাপানি সেনাদের  এমন বর্বরতা, মানসিক বিকৃতি কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। হত্যাকাণ্ডের একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠার জন্য তারা উদ্ভাবন করেছিল বিকৃত সব খেলা। যেমন মেয়েদের যোনিতে বর্শাবিদ্ধ করা, গুহ্যদ্বার বিদ্ধ করা, বাঁশ কঞ্চি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা ইত্যাদি।

বিচার

১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপানি বাহিনী আত্মসমর্পন করে। এর আগেই  মিত্রপক্ষ জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আনার লক্ষ্যে যদ্ধাপরাধ  ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ১৯৪৪ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ জাতিসংঘের উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। এর আরেকটি অংশ হিসেবে গঠিত হয় “দূর প্রাচ্য এবং প্রশান্ত অঞ্চল সংক্রান্ত ‘ওয়ার ক্রাইমস সাব কমিটি”। নানকিংয়ের হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের দায়ে তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট জাপানিদের বিচার শুরু হয়।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা এই বিচারের সময় সাক্ষ্য দেন প্রায় এক হাজার  প্রত্যক্ষদর্শী। মামলা হয়েছিলো পাঁচ শতাধিক। সড়কের মোড়ে মোড়ে নোটিশ সেঁটে দেওয়া হয়েছিল যাতে মানুষ সাক্ষ্য দিতে  আসে। এতে অনেক সেনা কর্মকর্তার  বিচার হয়েছে। প্রায় সবাইকেই ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যার রায় দেওয়া হয়। এরমধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য নানকিং এ অভিযান চালানো জাপানি সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ ডিভিশনের লেফটন্যান্ট জেনারেল তানি হিসাও। ১৯৪৬ সালের অগাস্ট মাসে তাকে বিচারের জন্য জাপান থেকে চীনে আনা হয়। ১৯৪৭ সালের ১০  মার্চ সামরিক  আদালত তানি হিসাওয়ের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এপ্রিলের ২৬ তারিখ লাখো মানুষের উপস্থতিতে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

 তবে গণহত্যার এই মর্মন্তুদ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও জাপানি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ও সম্রাট হিরোহিতোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত কিছু সামরিক নেতার শাস্তি হয়। দূরপ্রাচ্য আন্তর্জাতিক সেনা অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বেশ কয়েকজনকে এই যুদ্ধাপরাধের জন্য দণ্ড দেওয়া হলেও এর পেছনে মূল পরিকল্পনাকরী হিসেবে যাকে দেখা হয় সেই  জাপানি যুবরাজ আসাকাকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পনের শর্ত অনুসারে জাপানের সম্রাট অথবা রাজপরিবারের সদস্যদের পরবর্তীতে কোনো অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখিন করা যাবে না এমন  শর্তজুড়ে দেওয়ায় আসাকাকে  বিচারের সম্মুখিন করা যায়নি।  আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পনের  আগে  এই নির্মম গণহত্যার সব  প্রমানও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।

 

প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলাকালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জাপানি সেনারা যে সব ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সে  জন্য আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু জাপান কখনোই লিখিতভাবে নানকিংয়ের এই জঘন্য  বিভীষিকাময় গণহত্যার জন্য চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ অথবা কোনো ধরনের ক্ষমা চায়নি। বরং এ ব্যাপারে কোনো দায় নিতে তারা অস্বীকার করে আসছে। ২০১৫ সালে জাপানের  প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭০ বছর উপলক্ষ্যে যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন তাতে চীনে জাপানের এই বর্বরতার বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। এনিয়ে চীন-জাপান সর্ম্পকেও চরম টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়।